পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়
এখন এই সময়টা রবীন্দ্রনাথের সময়। কবিপক্ষের মাহেন্দ্রক্ষণ। অসংখ্য প্রেক্ষিতের মধ্যেও এক অনন্য প্রেক্ষিতে আলোকপাতের মাধ্যমে আমরা রবীন্দ্রনাথকে দেখব।
আমাদের দেশে, তথা সারা বিশ্বে ধর্ম নিয়ে নানান সময়ে নানান ঘটনাবলীর ইতিহাস আমরা জানি। রবীন্দ্রনাথ কিভাবে দেখেছেন,বা দেখতেন সেই বিষয়েই আজকের এই প্রসঙ্গ।
১৯১৭ সালে রবীন্দ্রনাথ “কর্তার ইচ্ছায় কর্ম” প্রবন্ধে লিখছেন–” দাসত্বের মন্ত্র পড়ে ধর্মতন্ত্র..”। ১৯৩৪ সালের ১০ই ডিসেম্বর রবীন্দ্রনাথ তাঁর এক গুণমুগ্ধ পাঠিকা হেমন্তবালা দেবীকে একটি চিঠিতে লিখেছিলেন –” সকল জাতির সকল শাস্ত্রই দৈবদত্ত নিখুঁত সত্যের অহঙ্কার করে,অথচ তাদের পরস্পরের সম্বন্ধ আদায় কাঁচকলায়।…শ্রেয়োবোধের অনুমোদিত শুচিতাকেই পালন করতে আমার প্রয়াস, যে বাহ্য আচার মানুষে মানুষে ভেদ ঘটিয়ে প্রাচীর তুলে বেড়ায় মানবপ্রেমকে, ঈশ্বরদত্ত বুদ্ধিকে অবজ্ঞা করে শাস্ত্রের অক্ষর বাঁচাবার জন্যে খুনোখুনি করতেও অগ্রসর হয়, তাকে বর্জন করে নাস্তিক অধার্ম্মিক পদবি নিতে আমার কোন সঙ্কোচ নেই।”
এখানে সবিনয়ে সবিশেষভাবে উল্লেখ্য, যে রবীন্দ্রনাথের রচনাবলী থেকে এলোমেলোভাবে পঙক্তি তুলে এনে তার চিন্তাধারাকে সবার সামনে এনে মানুষকে বিভ্রান্ত করা বিপজ্জনক। অসহিষ্ণুতা এবং দ্বেষ বিদ্বেষের সওদাগর যারা, তারা এই কাজ অতীতেও করেছেন,এখনো করছেন। কিন্তু,রবীন্দ্রনাথের ধর্ম ছিল স্বামী বিবেকানন্দের মতো বিশ্ব মানবতাবাদ। তাই তাঁর স্বপ্নের আশ্রমের নাম বিশ্বভারতী শান্তিনিকেতন।
আজ থেকে ১২৫ বছর আগে ১৯০০ সালে তিনি রচনা করেছিলেন “কথা ও কাহিনী ” কাব্যগ্রন্থের “দীন দান” কবিতাটি। আর তার ১০ বছর পরে ১৯১০ সালে লিখেছিলেন “গীতাঞ্জলি” কাব্যগ্রন্থের “ধুলা মন্দির” কবিতা। এই ধুলামন্দির কবিতায় তিনি সরাসরি তার বিশ্বাস,মনিনশীল চিন্তা দর্শন চিন্তা,ইত্যাদি প্রকাশ করেছেন দ্ব্যর্থহীনভাবে।
তিনি লিখছেন—” ভজন পূজন আরাধনা সব থাক্ পড়ে/ রুদ্ধদ্বারে দেবালয়ের কোণে কেন আছিস ওরে।/ অন্ধকারে লুকিয়ে আপন মনে/ কাহারে তুই পুজিস সংগোপনে / নয়ন মেলে দেখ দেখি তুই চেয়ে দেবতা নাই ঘরে।”
রবীন্দ্রনাথ দেবতার অস্তিত্বকে অস্বীকার করেন নি,বরং বলা যায় বিগ্রহস্থিত দেবতার পাশাপাশি তিনি সোচ্চারে ঘোষণা করেছেন নরদেবতার জয়গান। যেমন রয়েছে শ্রীরামকৃষ্ণ স্বমী বিবেকানন্দের ভাবনায়,যেমন রয়েছে আমাদের ভারতবর্ষের বহু প্রাচীন যুগ থেকে পরম্পরায় চলে আসা আমাদের দর্শনে—“শিব জ্ঞানে জীব সেবা” করার কথা,যেমন রয়েছে আমাদের চন্ডীদাসের সেই কালজয়ী উক্তি–“সবার উপরে মানুষ সত্য,তাহার উপরে নাই”। ঠিক তেমনই রবীন্দ্রনাথ তার ধর্ম এবং তাঁর দেবতাকে খুঁজেছেন মানুষের কর্মসাধনায়।
তিনি তাই বলছেন তার কবিতায়–“তিনি গেছেন যেথায় মাটি কেটে করছে চাষা চাষ/ পাথর ভেঙে কাটছে যেথায় পথ,খাটছে বারো মাস। // রৌদ্র জলে আছেন সবার সাথে/ ধুলা তাহার লেগেছে দুই হাতে/ তাঁরি মতন শুচী বসন ছাড়ি, আয়রে ধুলার ‘পরে। // রাখো রে ধ্যান, থাক্ রে ফুলের ডালি,/ ছিঁড়ুক বস্ত্র,লাগুক ধুলাবালি,/ কর্মযোগে তার সাথে এক হয়ে ঘর্ম পড়ুক ঝরে।”
এটাই তো ধর্মের সারাৎসার। এটাই তো কুসংস্কার মুক্ত ভারতীয় ধর্ম,দর্শনের মূল কেন্দ্রবিন্দু। আজ এই ভাবধারাকে,বিশ্বাসকে বিপন্ন করে ক্ষুদ্র,সঙ্কীর্ণ ধর্মীয় বিচারধারায় মানুষের মনকে আচ্ছন্ন করতে মরিয়া ধর্ম ব্যবসায়ীর দল। ধর্মের নামে সাম্প্রদায়িকতার অন্ধ চোরাগলিতে জন্ম হচ্ছে বিভেদের বিদ্বেষ, খুন হত্যা, ভিন্নধর্মী নারীর ইজ্জত লুণ্ঠন, আগুনে পুড়ে যাচ্ছে বসত। চিহ্নিতকরণ করা হচ্ছে সাম্প্রদায়িক হিংসার বিষ। হারিয়ে যাচ্ছে,কেউ খোঁজ করছে না সেইসব নরদেবতাদের, যারা এই দেশে অন্নহীন, বস্ত্রহীন, আশ্রয়হীন, কর্মহীন, চিকিৎসাহীন হয়ে কোটি কোটি অসহায় ভারতবাসী হিসাবে না মরেও জীবিত আছেন।
এই ধুর্ত স্বার্থপর অসহিষ্ণু সাম্প্রদায়িক কুচক্রীদের বিরুদ্ধে জনগণের লড়াইয়ে রবীন্দ্রনাথ আমাদের পথের দিশারি হোন, কান্ডারি হোন। রবীন্দ্রনাথই আমাদের মতো আপামর অতি সাধারণ ভারতবাসীর একমাত্র মুখপাত্র হোন।আমাদের মুখে প্রতিবাদের ভাষা দিন,আমাদের প্রতিরোধে সামিল হোন রবীন্দ্রনাথ আমাদেরই একজন হয়ে।