পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়
বসন্তবাহারের অনিন্দ্যসুন্দর আসামান্য ফুলকারি নৈসর্গিক সুষমায় ছেয়ে গেছে মধুমাস। এই মধুমাস যতক্ষণ থাকে,আমাদের মনে আর প্রকৃতির বনে ততক্ষন রঙিন ফাগ-ফাগুয়ার রামধনু রঙের বিচিত্র বৈচিত্র্যময় নকশীকাঁথা পাতা থাকে। প্রকৃতির কুঞ্জবন আর তার কুঞ্জছায়ায় এখন তাই অশোক, শিমুল, পলাশ, বকুল, পিয়াল, কামিনী, জুই, রজনীগন্ধা, বেলিমল্লিকা, কৃষ্ণচুড়া, রাধাচূড়া, প্রভৃতির শাখা প্রশাখায় মৌমাছি আর ভ্রমরের নিরন্তর আনাগোনা,আনন্দের ওড়াউড়ি। নতুন নতুন আমের বউলে-মুকুলে পরিপূর্ণ আম্রকানন। আবীরের আর রঙের মাতনে গেয়ে ওঠে মন–“আজ বঁধু সারা বেলা,হবে শুধু হোলিখেলা, ভুবনে এসেছে আজ মধু ফাগুয়া…//এমনি বিজনে মোরা দুজনে,শুধু রং ভরা পিচকারি,ক্ষণে ক্ষণে ছু্ঁড়ে মারি, রাঙাবো তোমারও তনু ওগো বঁধুয়া…”।
বৃন্দাবনের কৃষ্ণ একথা কি রাইকিশোরীকে বলেছিল? জানিনা,তবে,সেই আবেগের আবেশে আবিষ্ট হয়ে থাকে আমাদের জীবন যৌবন এবং মন।
রঙের এই পার্ব্বনই হল দোল,বা হোলি। মুঠোয় ভরানো রঙিন আবীর, আর জল মেশানো রঙের দামালপনা। সংস্কৃত শব্দ “হোলক্কা” থেকেই এসেছে হোলি শব্দটি,কেউ কেউ বলেন।কেউ কেউ আবার পুরানের কথা বলেন,যে,প্রাচীন কালে অসুররাজ হিরণ্যকশিপুর (যিনি ভগবান বিষ্ণুর চরম বিরোধী ছিলেন এবং তার পুত্র ভক্ত প্রহ্লাদ ছিলেন শ্রীবিষ্ণুর পরমভক্ত।এই প্রহ্লাদকে আগুনে পুড়িয়ে মারার জন্য হিরণ্যকশিপু তার বোন হোলিকাকে দায়িত্ব দেন।হোলিকা তার কোলে শিশু বালক প্রহ্লাদকে বসিয়ে জ্বলন্ত অগ্নিকুন্ডের মধ্যে প্রবেশ করেন। আগুনে পুড়ে যায় হোলিকা,চারিদিকে গড়িয়ে পড়ে তার রক্ত,আর স্বয়ং ভগবান বিষ্ণু রক্ষা করেন তার ভক্ত প্রহ্লাদকে। হোলিকার নাম থেকেই নাকি হোলি শব্দটি এসেছে।
তবে,ইতিহাসের বিভিন্নধারায় এই দোল বা হোলির কথা জানা যায়,সাহিত্যে,সঙ্গীতে,এবং আমাদের ব্যবহারিক জীবনেও। যেমন, কনৌজ থানেশ্বর সম্রাট রাজা হর্ষবর্ধন এর সময়কালেও দোল বা হোলির কথা পাওয়া যায়। পাওয়া যায় প্রিয়দর্শীকা,রত্নাবলী, কুমারসম্ভব,ঋতুসংহার, ইত্যাদিতে সংস্কৃত কবিদের এই বসন্ত তথা ফাগুন উৎসবের কথা তাদের রচনায়। বাৎসায়নের কামসূত্রেও এই বসন্তোৎসবের বিবরণ রয়েছে। সন্ত কবি সুরদাস এই রঙ নিয়ে অনেকগুলি পদ লিখে গেছেন। পঞ্চদশ শতকে বিদ্যাপতি “বসন্তোদয়” কাব্যে লিখছেন–” আওল ঋতুপতি রাজ বসন্ত।/ধাওল অলিকুল মাধবী -পন্থ।।// দিনকর-কিরণ ভেল পৌগন্ড।/ কেসর-কুসুম ধএল হেম দন্ড।।”
বৈষ্ণব পদাবলীতে জয়দেব,চন্ডীদাস,রূপ গোস্বামী, সহ অনেক পদকর্তা গণ লিখে গেছেন এই দোল বা হোলিকে নিয়ে। হোলি বা দোলের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে আছে দেবাদিদেব মহাদেব,শ্রীকৃষ্ণ,তথাগত বুদ্ধ,শ্রীচৈতন্য, গুরু নানক, শিরডির সত্য সাঁই, মীরাবাঈ, সন্ত কবীর, সন্ত রুইদাস, শ্রীরাধিকা, শ্রীরামকৃষ্ণ, শ্রীমা সারদা, প্রমুখদের নাম।
দোল বা হোলি কিন্তু কোনও একটি সম্প্রদায়ের উৎসব নয়। কারন আমরা ইতিহাসে পাই,মোঘল যুগে আকবর,জাহাঙ্গীর, শাহজাহান,বাংলার হুসেন শাহ,নবাব সিরাজউদ্দৌলা,প্রমুখরা এই হোলিরদিনে সকলের সাথে রঙের উৎসবে মেতে উঠতেন। ভারতের শেষ মোঘল সম্রাট বাহাদুর শা-জাফর এর সেই বিখ্যাত শায়েরি তো আমরা জানি–” কিঁউ মো পে রঙ্ মারি পিচকারী, / দেখো কুঁবরজি দুস্তগি ম্যায় গড়ি।”
আমাদের দেশের সঙ্গীতের একটি বিশেষ অঙ্গ জুড়ে রয়েছে এই দোল বা হোলি।এবং সেইসব গানের একটি বড় অংশ দেখা যায় আমাদের দেশের কবিদের লেখায়,সাহিত্যে,সিনেমায়, ইত্যাদিতে। যেমন,শ্রীকৃষ্ণ মা যশোদাকে অভিমানে জিজ্ঞাসা করে ওঠে শৈশবে — “যশোমতী মাঈয়া সে পুছে নন্দলালা,/ রাধা কিঁউ গোরী, ম্যায় কিঁউ কালা?” তখন সন্তান স্নেহে মা যশোদা বুদ্ধি দিলেন ছেলেকে,যে ফাল্গুনের পূর্ণিমার দিন রাইকিশোরীকে নানান রঙে রাঙিয়ে দিতে। এই কথা শুনে গোপীবালারা, গোপীবালকেরাও রঙ মাখতে চাইল।শুরু হোল রঙ খেলা,হোলি হ্যায়। কিশোর শ্রীকৃষ্ণ আনন্দে দোলের তথা হোলির নায়ক বনে গেলেন।
আমাদের দেশের অন্যতম সংস্কৃতির প্রাণপুরুষ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের অনেক গান রয়েছে এই বসন্ত তথা দোল উৎসবকে নিয়ে,রয়েছে কাজী নজরুল ইসলামের গান।তার প্রায় অনেকগুলিই বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সিনেমাতে ব্যবহার হয়েছে। গানগুলি হোল—“ওরে গৃহবাসী,খোল দ্বার খোল,লাগলো যে দোল..”, “রাঙিয়ে দিয়ে যাও, যাও,যাও গো এবার যাবার আগে…,” “ওরে ভাই ফাগুন লেগেছে বনে বনে..”, ” আজি রঙ লাগালে বনে বনে কে…”, “ঝরো ঝরো ঝরো ঝরো ঝরে রঙের ঝর্ণা..”, “ফাগুন হাওয়ায় হাওয়ায় করেছে যে দান..”, ” আজ সবার রঙে রঙ মেশাতে হবে…”,প্রভৃতি।
ভারতবর্ষের চলচ্চিত্রের (বাংলা,হিন্দি ইত্যাদি) অনেক জায়গাতে এই দোল বা হোলিকে কেন্দ্র করে গান তৈরী হয়েছে,চিত্রায়িতও হয়েছে। যেমন, “হোলি আয়ি রে কানহাই…” ( মাদার ইন্ডিয়া/শিল্পী -সামসাদ বেগম/ সুরকার -নৌসাদ), “তন্ রঙ্ লো জি…” ( কোহিনূর / শিল্পী – মহম্মদ রফী এবং লতা মঙ্গেশকর/ সুরকার- নৌশাদ), ” আজ না ছোড়েঙ্গে বাস্ হাম্ চোলি, খেলেঙ্গে হাম্ হোলি…”( কাটি পতঙ্গ/ শিল্পী -কিশোর কুমার), ” পিয়া তোসে নয়না লাগা রে…( গাইড/ শিল্পী – লতা মঙ্গেশকর/সুরকার -শচীন দেববর্মন), “হোলি কে দিন্ দিল্ খিল্ যা রে হ্যায়….” ( শোলে/ শিল্পী-লতা মঙ্গেশকর/সুরকার-রাহুল দেববর্মন), “রঙ বরষে … ” (সিলিসিলা/ শিল্পী – কিশোর কুমার/ সুরকার- রাহুল দেববর্মন), “হোলি খেলে রঘুবীরা…”( বাগবান/শিল্পী – অমিতাভ বচ্চন), ” হোলি আয়ি রে পিয়া জী রে দেশ রে…”( পদ্মাবত), ” বলম্ পিচকারি… ( ইয়ে জওয়ানি হ্যায় দিওয়ানি)।
বাংলা ছবিতে, যেমন, ” সাত্ সুরো কি বান্ধ্ পায়েলিয়া….হোলি হ্যায়..”( দাদার কীর্তি / শিল্পী – হেমন্ত মুখোপাধ্যায়,শক্তি ঠাকুর,সহশিল্পীরা/ সুরকার-হেমন্ত মুখোপাধ্যায়), “রঙ শুধু দিয়েই গেলে..” ( তিলোত্তমা / শিল্পী – মান্নাদে,আরতি মুখোপাধ্যায়, হৈমন্তী শুক্লা), “মনে না রঙ লাগলে তবে হোলি কেমন হোলি..” ( বন্দি/ শিল্পী -আশা ভোঁসলে,কিশোর কুমার), “খেলবো হোলি রঙ দেব না তাই কখনো হয়…” (একান্ত আপন/ শিল্পী-আশা ভোঁসলে,কবিতা কৃষ্ণমূর্তি/ সুরকার- রাহুল দেববর্মন), তরুণ মজুমদারের “বালিকা বধু”, শোলে সিনেমা সহ বাংলা,হিন্দি অসংখ্য সিনেমাতে দোল বা হোলির দৃশ্য আছে।এই দুই ভাষা ছাড়াও ভারতের প্রায় সমস্ত ভাষার সিনেমাতে এই দোল বা হোলির দৃশ্য আমরা পেয়ে থাকি।
বাংলায় “দোল”,উত্তরপ্রদেশে “লাট মার হোলি”, মহারাষ্ট্রতে “হোলিয়া”, উত্তরাখণ্ডতে “কুমায়নি হোলি”, বিহারে “ফাগুয়া”, উড়িষ্যায় ” দোলা”, গোয়ায় ” শিগমো”, মনিপুরে “ইয়াওসাং”, কেরালায় ” উক্কুলি”, মধ্যপ্রদেশে ” হোলিয়া”, আসামে “ফাগ-ফাগুয়া”, হিমাচল প্রদেশে “হোলিনু”, ত্রিপুরায় “দোল”, কর্নাটকে “মনিয়াপ্পান”, তামিলনাড়ুতে “কাট্টুমাম”, গুজরাটে “ধুলেত্তি”,দিল্লিতে “হোলি”, নেপালে ” ফাগু” ইত্যাদি বিভিন্ন নামে এই উৎসব পরিচিতি লাভ করেছে।
হোলিকে নিয়ে শায়েরী লিখেছেন মির্জা গালিব,ওমর খৈয়াম, মহম্মদ ইকবাল,সন্ত নিজামুদ্দিন আউলিয়া, হাসান শায়েরীবান, এন্টনী ফিরিঙ্গী, প্রমুখরা বিভিন্ন যুগে। এক কথায় বলা যায়, যে আমাদের এই দোল,হোলি এই বসন্তোৎসব আমাদের সকলের,সকল সম্প্রদায়ের, সকল শ্রেণির মানুষের এক মহামিলন উৎসব।
তাই এই মহোৎসব যেন সকলের আনন্দের হয়,যেন একজনের আনন্দ অন্যজনের সমস্যার বা বিপদের কারন না হয়,এই আবেদন রেখে গেলাম।আর আমাদের আনন্দ যেন অন্য প্রানীদের (পথ কুকুর,পথ বিড়াল, গরু,মহিষ, সহ অবলা প্রাণী,যারা তাদের গা নিজেরা জিভ দিয়ে চেটে পরিষ্কার করে) কোনও রকমের অসুবিধার কারন না হয়, সেদিকে আমাদের সকলকে সচেতন থাকতে হবে।রাসায়নিক রং ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকুন। ভেষজ রং, আবীর ব্যবহার করুন।শিশুদের সাবধানে রাখুন। ছোটদের সাথে থেকে রঙখেলাতে তাদের গাইড করুন।
সবার রঙে রং মিশিয়ে পালিত হোক এই দোল তথা হোলির বসন্তোৎসব, এই শুভ কামনা রেখে গেলাম।