পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়
সবার সঙ্গে শ্মশানের দিকে পা বাড়ালেন ছোট্ট রবি-ও। রবির সেদিন মনে হয়েছিল–” এই বাড়ির এই দরজা দিয়া মা আর একদিনও তাঁহার নিজের এই চিরজীবনের ঘরকন্নার মধ্যে আপনার আসনটিতে আসিয়া বসিবেন না।”
বেলা হল,শ্মশান থেকে ফিরলেন সবাই, গলির মোড়ে তেতলার ঘরের দিকে চেয়ে ছোট্ট রবি দেখল– বাবা দেবেন্দ্রনাথ তখনও তাঁর ঘরের সামনের বারান্দায় স্তব্ধ হয়ে উপাসনায় যেন বসে আছেন।
হয়তো এই ঘটনা রবীন্দ্রনাথ কে পরবর্তীতে লিখতে অনুভাবিত করেছিল,তিনি লিখলেন–“আছে দুঃখ,আছে মৃত্যু বিরহ দহন লাগে,//তবু্ও শান্তি,তবু আনন্দ,তবু অনন্ত জাগে।”
রবীন্দ্রনাথের জীবনে প্রথম দেখা “মরণ”, তাঁর মায়ের মৃত্যু। মৃত্যুর যে একটা রূপ আছে–যার মধ্যে বিরাজ করে শান্তভাব,স্তব্ধতা, মৌন হাহাকারের শূণ্যতা, কান্নার চেয়েও গভীর এক রিক্ততা, বিদীর্ণ বিষন্ন বিরহভাব–এই উপলব্ধি হয়েছিল অল্প বয়সে মা-হারানো রবির।
রবীন্দ্রনাথ পরবর্তী সময়ে ধীরে ধীরে অতিক্রান্তিত,অনুভাবিত হয়েছিলেন দৈনন্দিন ব্যবহারিক জীবনের অভ্যাসের বাইরে এক অন্তর্লীন একান্ত তাঁর একার অনুভবে–” জীবন মরনের সীমানা ছাড়ায়ে বন্ধু হে আমার রয়েছো দাঁড়ায়ে..”// “নয়ন সমুখে তুমি নাই,নয়নের মাঝখানে নিয়েছো যে ঠাঁই..”।
” আজ এ ঘর হয়েছে শ্রীহীন,/এ সত্য, তার চেয়ে বড়ো সত্য তুমি ছিলে একদিন..”।
বোধহয়, সারাজীবনে রবীন্দ্রনাথ বিভিন্নধরনের সম্পর্কের বিভিন্ন আঙ্গিকে মৃত্যুকে দেখেছিলেন। তিনি কখনও মৃত্যুকে এক সময়ে “মরন রে তুঁহু মম শ্যাম সমান..” বলে অভিহিত করিছেন,আবার,কখনো তিনি দ্বিধাহীন ভাষায় আকুতি জানাচ্ছেন.. -“মরিতে চাহিনা আমি সুন্দর ভুবনে…”।
নিয়তির অমোঘ বিধানে জানি পরিসমাপনের দ্বারপ্রান্তে অবধারিতভাবে অপেক্ষা করে দাঁড়িয়ে থাকা মরনকে নিয়ে তিনি ভালোবেসে বলছেন– “আমি মৃত্যুর চেয়ে বড়,এই কথা বলে,/ যাব আমি চলে..”।
বিশ্বকবির কাছে মরন বুঝি মরন নয়।মৃত্যু হল মৃত্যুঞ্জয়ী। তাই তিনি বলছেন–” যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে…,/তখিন কে বলে গো সেই প্রভাতে নেই আমি,//সকল খেলায় করিবে খেলা এই আমি,/নতুন নামে ডাকবে মোরে,বাঁধবে নতুন বাহুডোরে,/ আসবো যাবো চিরদিনের সেই আমি…”।
রবীন্দ্রনাথের শুভ জন্মদিনের প্রাক্কালে রেখে গেলাম আমাদের বিনম্র প্রণতি।