পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়: যে সমস্ত ভারতীয়দের এখন ৪০/৪৫ বছর বয়েস,তারা তাদের ছোট বেলায় একটি সুর নিশ্চয়ই শুনেছেন, সেটা হোল রেডিওতে ভোর বেলায় রেডিওর অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার ঠিক আগে যে সুরটি বাজতো,যদিও সেই সুর রেডিওতে দিনের শুরুতে আজও বাজে। সেই সুরটির মুগ্ধতা আজও সেই সব মাঝ বয়সী,বা আর একটু বেশী বয়সের মানুষদের কাছে যেমন আকর্ষণীয় হয়ে আছে,ঠিক তেমনই নতুন প্রজন্মের কাছেও অন্তত শারদীয়া উৎসবের প্রাক্কালে মহালয়ার ভোরে সেই সুর পরিচিতি লাভ করে। তাই বলা যায় যে সেই সুরের মূর্ছনা বহুল প্রচারিত ছিল এবং চিরকালীন হয়ে থাকবেও চিরকাল। আর ভালোবাসায় মোড়া সেই কালজয়ী সানাইয়ের
সুরটির স্রষ্টার নাম হোল বিশ্বখ্যাত সানাই বাদক শিল্পী উস্তাদ বিসমিল্লাহ্ খান।
উস্তাদ বিসমিল্লাহ্ খান…যাঁর আসল নাম ছিল কামারুদ্দিন খান। বাবা পয়গম্বর খান এবং মা বেগম মিঠান দেবীর দ্বিতীয় সন্তান বিসমিল্লাহ’-র জন্ম হয়েছিল ১৯১৬ সালের ২১ শে মার্চ বিহারের ডুমরাঁও রাজ্যে। তাঁর ঠাকুরদাদা রসুল বক্স খান এবং পূর্বপুরুষেরা ছিলেন ডুমরাঁও রাজ্যের রাজসভার সঙ্গীত পরিবেশক।
শিশু জন্মানোর পরেই ঠাকুরদাদা আনন্দে বলে উঠেছিলেন ” বিসমিল্লাহ.”,অর্থাৎ ঈশ্বরের নাম নিয়ে বা আল্লাহর নাম-করুনা নিয়ে শুরু করা কোন মহৎ পবিত্র কাজ..।
সেই থেকে কামারুদ্দিন খান– এর নাম হোয়ে গেল “বিসমিল্লাহ খান”। সারা পৃথিবী পরে যাকে চিনবে বিশ্বখ্যাত সানাই বাদক হিসাবে।
বিসমিল্লা খানের ছোটবেলার প্রথম শিক্ষা মক্তবে,পরে স্থানীয় মাদ্রাসাতে। তবে ছোট থেকেই তিনি ছিলেন সুরের সঙ্গে ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। তাই তিনি সঙ্গীতের প্রথম পাঠ নেন প্রয়াত আলী বকস্ বিলায়েতুর কাছে। এখানে উল্লেখযোগ্য যে এই উস্তাদ আলী বকস্ বিলায়েতু ছিলেন বারানসীর মানে কাশীর বিখ্যাত বিশ্বনাথ মন্দিরের নিয়মিত সানাই বাদক। এই গুরুর প্রভাব এবং বিসমিল্লা খানের পারিবারিক উদার মনোভাবের প্রভাব তাঁকে এক মহৎ প্রান ইনসানে পরিনত করেছিল।তাই তিনি যেমন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজী ছিলেন, পাশাপাশি তিনি জ্ঞান-বিদ্যা-সুরের দেবী সরস্বতীরও পুজো করতেন।শুধু তাই নয়,তিনি আজীবন বসবাস করে গেছেন বেনারসে-কাশীতে।তিনি বলতেন আমার ঈশ্বর – আল্লাহ্-র নাম হোল সঙ্গীত আর সুরের বিস্তার।
সানাই বাদ্যযন্ত্রটিকে আমাদের দেশের শাস্ত্রীয়-উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত জগতের সাম্রাজ্যে অত্যন্ত সসম্মানে,সমাদরে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন।
১৯৩৭ সালে কলকাতায় অল ইন্ডিয়া মিউজিক কনফারেন্সে বিসমিল্লা খান সানাই বাজিয়ে এই সানাই কে সঙ্গীতের প্রধান মঞ্চের পাদপ্রদীপের আলোতে নিয়ে আসেন। ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষের স্বাধীনতার প্রথমদিনেরপ্রথম আলোর ভোরে (তৎকালীন রেডিওর একটি মাত্র তরঙ্গ ছিল) রেডিওতে বেজে উঠেছিল উস্তাদ বিসমিল্লাহ খানের সেই সকলের মনকাড়া সানাই বাদন।
এরপর ১৯৪৮ সালে মহাত্মা গান্ধীর আততায়ীর হাতে নিহত হওয়ার পরে সারা বিশ্বে, সারা দেশে যে গভীর শোকের উদ্রেক হয়েছিল,তাকে সম্মান জানিয়ে উস্তাদ বিসমিল্লাহ খান মহাত্মা গান্ধীর মহা-সমাধি তে বাজিয়েছিলেন জাতির পিতার সেই প্রিয় গানের সুর..”রঘুপতি রাঘব রাজারাম,সবকো সন্মতি দে ভগবান,/ ঈশ্বর-আল্লাহ তেরে নাম, সবকো সন্মতি দে ভগবান..”
১৯৫০ সালের ২৬ শে জানুয়ারী প্রথম প্রজাতন্ত্র দিবসে দিল্লীর লালকেল্লাতে অনুষ্ঠিত অনুষ্ঠানে বিসমিল্লাহ খান সাহেব অন্তরের সবটুকু উজাড় করে, আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে সানাইয়ের সুরে সুরে কাফি রাগের সপ্তসুরের মুর্ছনাতে সেদিন আকাশ বাতাস মোহিত
করে তুলেছিলেন। এখানে উপস্থিত ছিলেন দেশের বিদেশের অনেক রাষ্ট্রপ্রধান এবং অন্যান্য ব্যক্তিবর্গ।
১৫ ই আগস্ট স্বাধীনতা দিবসে দিল্লীর লালকেল্লা থেকে দেশের প্রধানমন্ত্রীর জাতির উদ্দেশ্যে ভাষনের পরে অবধারিতভাবে ছিল উস্তাদ বিসমিল্লাহ খানের সানাই বাদন, সেই জওহরলাল নেহরুজীর আমল থেকে যার শুরু।এই অনুষ্ঠান পরে দুরদর্শন থেকে সম্প্রচারিত হোত।
আর পরবর্তী সময়ে যখন উস্তাদ-জীর সানাই বাদনের রেকর্ড বা তারওপরে ক্যাসেট প্রকাশ হল,তখন থেকেই সারাদেশে যে কোন উৎসব অনুষ্ঠানে তা বেজে উঠতো এবং এখনও ওঠে সেই বিসমিল্লাহ খানের মধুরতায় ভরা সানাইয়ের সুর লহরী। তাই ভারতবর্ষ… ভারতীয় নাগরিক…তাদের উৎসব-অনুষ্ঠান…আর উস্তাদ বিসমিল্লাহ খানের সানাইবাদন…এক আসনে সমাদৃত, সমাহিত। এটাই বলা যায় আমাদের পরম্পরা,ঐতিহ্য,গৌরবময় ইতিহাস।এক সম্প্রীতির, মহামিলনের উদাহরন।
কবির ভাষায়ঃ
“অনুষ্ঠানে উৎসবে,
ষোলকলা পূর্ণ হবে,
উঠবে ভরে প্রান../
শ্রুতিমধুর অনুভবে,
বেজে যদি ওঠেন তবে, বিসমিল্লাহ খান..”।
কিম্বা,
“দুই নয়নের দুটি তারা
হিন্দু-মুসলমান..
ভালোবাসার আরেক নাম
বিসমিল্লা খান…”
বিসমিল্লাহ খান সাহেব সারা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে তাঁর সঙ্গীত প্রতিভার বিস্তার এবং অনুষ্ঠান করে গেছেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হোল, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র,,রাশিয়া( পূর্বতন সোভিয়েত ইউনিয়নের দেশ সমুহ) ইংলন্ড,ফ্রান্স,জাপান,জার্মান, ইটালি,ইউরোপের সমস্ত দেশে, আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে,ইরান,ইরাক,সৌদি আরবের দেশগুলিতে,পাকিস্তান,শ্রীলঙ্কায়,আফগানিস্তানে,চীনে,মালয়েশিয়ায়, ইন্দোনেশিয়ায়, হংকংয়ের বিভিন্ন জায়গাতে, ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলিতে,ওয়েস্ট ইন্ডিজে,অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডে,আয়ারল্যান্ড, ডেনমার্ক,সুইজারল্যান্ড,নরওয়ে,পোল্যান্ড,সুইডেন,চেক প্রজাতন্ত্রে,যুগোশ্লোভাকিয়া, প্রমুখ দেশগুলিতে।
উস্তাদ বিসমিল্লাহ খান ভারতীয় চলচ্চিত্রের সাথেও বিভিন্ন কাজ করেছেন। বিশ্ব-বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের “জলসাঘর” সিনেমাতে তিনি অভিনয় করেছেন, এবং গুঞ্জে উঠে সানাইয়ের অংশে তিনি সানাইও বাজিয়েছিলেন। “সনাদি অপন্যা” সিনেমাতে ডঃ রাজকুমারের চরিত্রের জন্য তিনি সানাই বাজিয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক গৌতম ঘোষের পরিচালনায় উস্তাদ বিসমিল্লাহ খানের জীবন এবং তাঁর কর্মের ওপরে যে প্রামান্যচিত্র “সঙ্গ মিল সে মুলাকাত” তৈরী করা হয়,তাতে শিল্পী স্বয়ং অংশগ্রহণ করেছিলেন।
তিনি সারা জীবনে বহু পুরস্কারে সম্মানিত হন। তার মধ্যে অন্যতম “সঙ্গীত নাটক একাডেমি” পুরস্কার( ১৯৫৬), মধ্যপ্রদেশ রাজ্য সরকার দ্বারা “তানসেন পুরস্কার(১৯৫৯), ভারত সরকার দ্বারা “পদ্মশ্রী” পুরস্কার(১৯৬১), ভারত সরকার দ্বারা “পদ্মভূষণ” (১৯৬৮) সম্মানে সম্মানিত হন, ১৯৮০ সালে তিনি ভারত সরকার দ্বারা “পদ্মবিভূষণ ” সম্মানেও সম্মানিত হন, ইরান প্রজাতন্ত্রের “তালার মৌসিকি” (১৯৯২) সম্মান প্রাপ্ত হন, ১৯৯৪ সালে “সঙ্গীত নাটক একাডেমি” র ফেলো সম্মানে ভুষিত হন তিনি, ২০০১ সালে তাঁকে আমাদের দেশের সর্বোচ্চ সম্মান “ভারত রত্ন” প্রদান করা হয়।
উস্তাদ বিসমিল্লাহ খান সাহেব কে বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় “সম্মানসূচক ডক্টরেট” সম্মানে সমাদৃত করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ও তাঁকে সম্মানসূচক “ডক্টরেট” সম্মানে সম্মানিত করেন, বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে “দেশিকোত্তম ” সম্মানে ভুষিত করেন।
এতো সুনাম,সম্মান, অর্জন করা সত্ত্বেও তিনি ব্যক্তিগত জীবনে অতি সাধারণভাবে জীবন যাপনে অভ্যস্ত ছিলেন। সব সময়েই তিনি থাকতেন বারানসীতে,সেই পুরানো জায়গাতে,যেমন ছিলেন সংগীতশিল্পী জীবনের শুরুতে। স্থানীয়ভাবে তাঁর কোথাও যাতায়াতের জন্য বাহন ছিল একমাত্র সাইকেল রিকশা। আজীবন অতি অন্তর্মুখী স্বভাবের, বিনম্র চরিত্রের মানুষ উস্তাদ বিসমিল্লাহ খান অন্তর থেকে বিশ্বাস করতেন সঙ্গীত হোল সাধনার বিষয়। সম্প্রীতি হোল চরিত্রের ঔদার্যবোধ। মানুষের অন্তরে অন্তরেই রয়েছেন ঈশ্বর-আল্লাহ্-র করুনার রহম্ আর মসজিদ মন্দিরের পবিত্র দালান-দরগা।
এই ভরা ভাদ্রেই সানাইয়ের সুর থেমে গিয়েছিল বেনারসের হেরিটেজ হাসপাতালে ২০০৬ সালের ২১ শে আগস্ট। কিন্তু বিসমিল্লাহ খান সাহেব চিরকাল থাকবেন অমর হোয়ে সুরে সুরে, সঙ্গীতে,মানুষের অন্তরে অন্তরে সম্প্রীতির আলোকপাতে।