পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়
মান্না দে-র “জীবনের জলসাঘরে ” আত্মকথা থেকে জানা যায়, যে, একটি পাতলা চেহারার তরুণ এসেছিলেন মান্না দে-র কাকা সঙ্গীতপুরুষ কৃষ্ণচন্দ্র দে-র কাছে। গান গাইবার জন্য। খুব ভালো লেগে গিয়েছিল কাকার তার গান। এরপর তার গান রেকর্ড করার জন্য অনেক চেষ্টা করা সত্ত্বেও কেউ সেই তরুণ ছেলেটির জন্য গান লিখতে রাজি হননি। শেষে কৃষ্ণচন্দ্র দে ছেলেটিকে নিয়ে গেলেন সাহিত্যিক কবি হেমেন্দ্রকুমার রায়ের কাছে। হেমেন্দ্রকুমার রাজি হলেন এবং লিখে দিলেন গানের কথা। সুর দিলেন স্বয়ং সেই ছেলেটি। কিন্তু রেকর্ড হবে কোথায়? তাও ঠিক করে দিলেন মান্না দে-র কাকা কৃষ্ণচন্দ্র দে। তখন চণ্ডীদাস সাহা নামে একজন ৬/১ অক্রুর দত্ত লেনে হিন্দুস্তান মিউজিক্যাল প্রোডাক্টস নামে একটি রেকর্ড কোম্পানি খুলেছিলেন, সেখানেই রেকর্ড করা হোল গান..”ডাকিলে কোকিল রোজ বিহানে..”।
এরপর সেই তরুণ চলে যান বোম্বেতে। সেখানে গিয়ে অনেক লড়াই করেও কোনও সুরাহা করতে পারেননি। সকলেই তাকে বলতেন,তার গলার স্বর “নাকে সুরে”। গান ভালো হবেনা। এমনকি রেকর্ড করা গানও বাতিল করে দেওয়া হয়। সিনেমার নাম ছিল ” ইহুদি কি লেড়কি”।
খুব চিন্তায় পড়লেন ছেলেটি।তাহলে কি তার দ্বারা গান হবে না? সে যে সুরকার হতে চায়..এতো তার সেই ছোট বেলার স্বপ্ন। তবে কি সব ছেড়ে তাকে ফিরে যেতে হবে কুমিল্লায়?
এইসময়ে তিনি একদিন গেলেন তখনকারদিনের বিখ্যাত গায়িকা সামসাদ বেগমের কাছে।অনেক অনুনয় বিনয় করে তাঁকে রাজি করালেন। সামসাদ বেগম গান করলেন…”কুছ রঙ বদল রহি হ্যায়..”। এরপর সামসাদ বেগম গাইলেন এবং নবাগতা বৈজয়ন্তীমালা নাচলেন সেই গানে অনবদ্য,সেই গান হয়ে রইল সামসাদ বেগমের signature song… “সইয়াঁ দিল্ মে আনা রে..”। সুর দিয়েছিলেন সেই তরুন।
হ্যাঁ,সেই তরুণ সুরকারের নাম শচীন দেববর্মন। যার হাত ধরে কিশোর কুমার,মান্না দে,প্রমুখরা সঙ্গীত জগতে নক্ষত্র হয়েছেন।এমন কি অনেক গীতিকারের প্রতিষ্ঠাও তিনি করিয়েছেন।তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন কাইফি আজমি(শাবানা আজমি-র বাবা)।
শচীন দেববর্মন ১৯০৬ সালের ১লা অক্টোবর কুমিল্লায় (এখন বাংলাদেশে) জন্মগ্রহণ করেন।শচীন দেববর্মান-রা ছিলেন ত্রিপুরার রাজ পরিবারের মানুষ । বাবার নাম ছিল নবদ্বীপচন্দ্র দেববর্মন।আর মা নির্মলা (মতান্তরে নিরূপমা) দেবী ছিলেন মণিপুরের রাজকুমারী।
শচীন কত্তার গানে ছিল বাংলার লোকগানের সুর,মাটির সুর…।যা এক কথায় অনিন্দ্যসুন্দর,শ্রুতিমধুর। গান ছিল শচীন কত্তার প্রাণের দোসর।আর ছিল অতিপ্রিয় ফুটবল খেলা।
তিনি প্রায় ৩০০ ছবিতে সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন। অসংখ্য কালজয়ী গান তিনি তৈরী করে গেছেন।যা আজও সমানভাবে জনপ্রিয়।
তিনি নিজের জন্মভূমি এই বাংলা কে কখনও ভোলেননি। যেমন ভোলেননি ফুটবল এবং তার প্রিয় টিম-কে।
জীবনের শেষ ৫মাস তিনি প্যারালিটিক্যাল স্টোকের কারনে তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় ছিলেন।রোজই কাজ সেরে পুত্র রাহুল দেববর্মন আসতেন বাবার কাছে,আর অন্য সময়ে থাকতেন শচীন কত্তার স্ত্রী প্রখ্যাত গীতিকার মীরা দেববর্মন।দুজনেই শচীন দেববর্মনের কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে কুমিল্লার কথা,গানের কথা,ফেলে আসা অতীতের নানা কথা শোনাতেন,যদি তিনি তাই শুনে একটু সাড়া দেন,এই আশায়।
সেদিন রাহুল দেববর্মন “মিলি” সিনেমার রেকর্ডিং সেরে ফিরে বাবার কাছে গিয়ে দেখেন,বাবার অবস্থা প্রায় অন্তিম অবস্থায়। কোমায় প্রায় চলে গেছেন শচীন কত্তা। রাহুল শচীন দেববর্মনের কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে ফিসফিস করে বলেছিলেন..
“বাবা,৫-০ তে জিতেছে তোমার টিম..”। তাই শুনে কোমাচ্ছন্ন শচীন দেববর্মনের ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি ফুটে উঠেছিল সেদিন,–চোখ খুলেছিলেন একটু—অস্ফুট স্বরে বলেছিলেন.. “ইস্টবেঙ্গল জিতসে..!!??”
এই ছিল তার শেষ কথা..। তারপর সব শেষ। সেই দিনটা ছিল ৩১ শে অক্টোবর, ১৯৭৫ সাল।
ভারতীয় সঙ্গীত জগতের প্রবাদপ্রতিম মানুষ শচীন দেববর্মন-কে জানাই প্রণাম।