পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়
আজ থেকে প্রায় ৫০ বছর আগের একটি সিনেমার গান শুনে শুনে আমরা বড় হয়েছি, সিনেমাটা ছিল যদিও বলা হয় ছোটদের, কিন্তু বোধহয় না,তার মর্মার্থ ছিল এক শাশ্বত বাস্তবতার। আর গানের লাইনগুলো ছিল… “ওরে হাল্লা রাজার সেনা, তোরা যুদ্ধ ক’রে করবি কি তা বল্… মিছে অস্ত্র-শস্ত্র ধরে প্রাণটা কেন যায় বে-ঘোরে,রাজ্যে রাজ্যে পরস্পরে দ্বন্দে অমঙ্গল, তোরা যুদ্ধ করে করবি কি তা বল্..”
হ্যাঁ, সত্যজিৎ রায়ের ‘গুপী গায়েন বাঘা বাইন’ সিনেমার গান ছিল এটা। যদিও এই গানের কথা আজও প্রাসঙ্গিক।
এই তো মাত্র কিছুদিন আগেই চলছিল রাশিয়া ইউক্রেন-এর বিধ্বংসী যুদ্ধ, এখন চলছে প্যালেস্টাইন-ইসরায়েলের যুদ্ধ। অতীতে অনেক যুদ্ধ হয়েছে। রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয়েছে, মরেছে অসংখ্য উলুখাগড়ার দল, মানে সাধারণ মানুষ। যেমন এই সময়ে প্রতিদিন খবরে প্রকাশ পাচ্ছে, ইসরায়েল প্যালেস্টাইনের যুদ্ধে গাজা নামক ভুখন্ডের করুন মর্মান্তিক খবর,যা আমাদের মনকে বিষন্ন করে তুলছে,ভাবিয়ে তুলছে।
গাজায় এই মুহুর্তে আর কোন অক্ষত বাড়ি নেই,নেই কোনও হাসপাতাল।বাড়িঘর গুঁড়িয়ে দেওয়ার ফলে আহত মানুষ যখন হাসপাতালের শয্যায় চিকিৎসার জন্য শায়িত,তখন সেই হাসপাতালের ওপরও ফেলা হচ্ছে ক্ষেপনাস্ত্র, রোগীসহ সকলের মৃত্যু নিয়ে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে হাসপাতাল। এই কাজ করা হচ্ছে যুদ্ধের দাম্ভিকতার আস্ফালন নিয়ে।
প্রতি ১০মিনিটে গাজায় ৫ জন করে শিশু নিহত হচ্ছে,আহত হচ্ছে অন্তত ২০/২৫ জন। প্রতিদিন ১৬৩ -১৭২ জন শিশু মারা যাচ্ছে। ১৮/১১/২০২৩ পর্যন্ত গাজায় নিহতের সংখ্যা ২১ হাজার ৭৮ জন। অপরদিকে হামাসের মত এক সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠী, তারা অকথ্য অত্যাচার আক্রমণ চালায় ইসরায়েলের ওপর,যার ফলে ইসরায়েলের নিহতের সংখ্যা দাঁড়ায় ১৬হাজার। উভয় পক্ষের যারা মারা গেলেন তারা সকলেই সাধারণ মানুষ। এখন প্রশ্ন হলো এত হিংসা, এত হত্যা,এত ধ্বংসকেন?
আজকের আধুনিক পৃথিবীতে চারিদিক জুড়ে মানুষের কাজে এবং ব্যবহারে এত অমানবিকতা কেন? তাহলে কি যে সহনশীলতার গুণে মানুষ নিজেকে মানুষ বলে দাবী করে,সেই গুণগুলি আজ ক্রমক্ষয়মান বা বিলুপ্তির পথে? তাহলে এই সভ্যতা বাঁচবে কি ক’রে? মানুষ, আমরা বাঁচবো কি ক’রে?
আজ আমাদের জীবনের প্রাত্যহিক অভিজ্ঞতায় আমরা দেখতে পাচ্ছি,আমাদের ঘরে বাইরে,এলাকায়,রাজ্যে,দেশে,সারা বিশ্বে মানুষের মনে হিংসা,এবং সেই হিংসার ন্যক্কারজনক ও ধিক্কারজনক ঘটনার ঘনঘটা। কখনো তা জাত-পাত, জাত-ধর্ম,জাতীয়তাবাদ-মৌলবাদের জিগির তুলে,আবার কখনো বা রাজনীতির নামে,দলের আভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রেই হোক,বা অপরাপর রাজনৈতিক দলগুলোর বিরোধিতার কারনেই হোক। আর এর পেছনের নাটেরগুরু যারা,তারা এই সমাজে ধোয়া তুলসীপাতার মতো ঘুরে বেড়ায়। অবশ্য সমাজের কিছু তাঁবেদার-পদলেহনকারীদের তারা তাদের পক্ষে পেয়ে যায় ইয়েসম্যান হিসাবে।
আমাদের ইতিহাস থেকে আমরা জানতে পারি,যে,আধুনিক মানব সভ্যতার শুরু হয়েছিল কৃষি দিয়ে। এই বসুন্ধরার মাটিতে, প্রকৃতিতে যা কিছু প্রকৃতিগত এবং উৎপাদনগত সম্পদ,তা যদিও সকলের অধিকারভুক্ত, কিন্তু,সেই মানবিক দায়বদ্ধতা এবং উদার সাম্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গীকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে এক শ্রেণীর মানুষ অপর এক বিপুল সংখ্যক মানুষকে বঞ্চিত করে,ভুখা রেখে,বলপূর্বক শক্তিশালী মানুষ তাদের হত্যাকরে,ঘরছাড়া করে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করেছে।কোনও রকমের ন্যায়-নীতির তোয়াক্কা না করে। এই কাহিনি সেই প্রাগৈতিহাসিক যুগের তথাকথিত মহাকাব্য-পুরাণ থেকে শুরু হয়েছে,যা আজ অবধি বহমান যুগে যুগে দেশে দেশে।
এই অনৈতিক,অমানবিক স্পৃহা মানুষকে লোলুপতায় প্রলুব্ধ করেছে বারেবার,করেছে নির্মম,নিষ্ঠুর। আমরা জানি,বিশ্বযুদ্ধগুলির ইতিহাস কোটি কোটি মানুষের ধ্বংসের কারন। আমাদের দেশের অপরিনামদর্শী নেতাদের অর্বাচীনতায় দেশভাগের সময়ের যে দাঙ্গার ইতিহাস তাও আমরা জানি,যেখানে লক্ষ লক্ষ মানুষ খুন হয়েছে,ধর্ষিতা হয়েছে,ঘরছাড়া হয়েছে ১১ কোটি মানুষ। । আমরা জানি,কিভাবে উপনিবেশ তৈরির জন্যে, নিজেদের স্বার্থ-র জন্য যুগে যুগে শক্তিশালীরা এই বিশ্বের আদি অধিবাসীদের,কোন স্থানের,বা জঙ্গলের আদিবাসীদের কোণঠাসা করেছে নানান ছলচাতুরীতে, অত্যাচারে,হত্যায়,গায়ের জোরে যুদ্ধের নামে হিংস্রতায়। আর এখন তো সারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এক একটি অস্ত্রস্তুপের বিশাল বিশাল ভাণ্ডার।
অতীত থেকে আজ অবধি সমস্ত রকম যুদ্ধের কারন হলো অন্য দেশের খণিজ তেল,প্রাকৃতিক সম্পদ,,ইত্যাদির দখলদারিত্বের অভিসন্ধি। আর এর জন্য শুরু হয় যুদ্ধ। সেই যুদ্ধের লক্ষ্য হয় আক্রান্ত দেশের জমি দখল করা এবং সেখানকার অসহায় নারীদের ধর্ষন করে,সেই জাতটার মেরুদণ্ড ভেঙ্গে দিয়ে সেই জাতির নারীদের দখল করা।এই পদ্ধতি আমরা ইতিহাসে বারংবার পেয়েছি। আমাদের দেশ ব্রিটিশের,ফরাসীদের মৃগয়াক্ষেত্র ছিল ১৯০ বছর।তার আগে মুঘলদের দখলদারিতে।তারও আগে আর্যদের, ইত্যাদি ইত্যাদি। এইরকম ইতিহাসের ছড়াছড়ি এই পৃথিবীর মানচিত্রে।
আর এই যুদ্ধের ভয়ঙ্করী তাণ্ডবলীলার শিকার হয় সাধারণ মানুষ। ইদানিং, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার তেলের দখলদারি নেওয়ার জন্য যুদ্ধ্ব চলেছে দীর্ঘদিন ধরে। শিখন্ডি খাড়া করা হচ্ছে অন্য কিছু,কিন্তু আসল লক্ষ্য বড় বড় দেশগুলোর অস্ত্রব্যবসার বাজার প্রসার করা,আর ছোট ছোট দেশগুলোর খনিজ সম্পদ দখল করা, এবং সেইসব দেশে নিজেদের ব্যবসাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ঘৃন্য চক্রান্তের সাম্রাজ্যবাদী মানসিকতা।
আর এইসব যুদ্ধের লক্ষ্য হচ্ছে সাধারণ মানুষ। সাম্প্রতিককালে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধই হোক, বা এইসময়ের প্যালেস্টাইন ইসরায়েলের যুদ্ধেই হোক, ক্ষেপণাস্ত্রের লক্ষই হচ্ছে সাধারণ মানুষ, নারী,শিশু-রা। এমন কি বাদ যাচ্ছেনা হাসপাতালগুলোও। আর সবচেয়ে মর্মান্তিক ব্যাপার হলো, যে, এহেন ধ্বংসাত্মক তাণ্ডবের শুধুমাত্র দর্শক হয়েই রয়েছে বিশ্বের অন্যান্য দেশের নেতারা (কয়েকজন ব্যতিক্রমী ছাড়া), এমন কি স্বয়ং রাষ্ট্রপুঞ্জ-ও আজ নীরব সাক্ষী হয়ে রয়েছে।এটাই খুবই বেদনার। আজ গাজার সাধারণ মানুষের একটিই কাতর প্রার্থনা, আমাদের বাঁচতে দাও,আমরা বাঁচতে চাই। ওগো শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানবতার পূজারী পৃথিবী, তোমরা চুপ করে থেকো না। তোমরা চুপ করে থাকলে, আমরা,এই অসহায় মানুষরা কার কাছে বিচার চাইবো? আমরা বাঁচবো কিভাবে? আমরা বাঁচবো কি ক’রে?
তাই,আমরা এই ভারতবর্ষের মানুষ,এই বিশ্বের সহ নাগরিক,…করজোড়ে প্রার্থনা করছি, যাবতীয় যুদ্ধের অস্ত্র এই পৃথিবীর পদপ্রান্তে আত্মসমর্পন করুক,আর হিংসা নয়,পররাজ্য দখলের নামে মানুষ-মারা নয়,আর কোনও যুদ্ধ নয়, আমরা শান্তিতে সহাবস্থান করতে চাই,আমরা ভালোবাসা দিতে চাই,নিতে চাই,দরদ সহানুভূতি, সমানুভূতি চাই,সসহিষ্ণুতা চাই, আমরা সকলের জন্য শান্তি সমৃদ্ধি কামনা করি।সকলের জন্য মঙ্গল কামনা করি। সকলের শুভবুদ্ধির উদয় হোক। উচ্চারিত হোক সেই প্রাচীন স্তবগাথা…
“অসদ মা সদগময়,
তমসো মা জ্যোতির্গময়, মৃত্যোর্মা অমৃতং গময়,
ওঁ তৎসৎ,ওঁ শান্তি,ওঁ শান্তি,ওঁ শান্তি।
যুদ্ধ নয়,শান্তি চাই। এই পৃথিবীর সমস্ত শান্তিপ্রিয়,অহিংসব্রতে ব্রতী মানুষের হয়ে আমাদের বিনম্র আবেদন রইল এই পৃথিবীর কাছে।