পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়
সে এক সময় ছিল, যখন এই বাংলায়, এই ভারতবর্ষে, এবং এই দক্ষিণ এশিয়ার উপমহাদেশে পুরুষদের কোনো শিক্ষার ব্যবস্থাই ছিল না। মহিলাদের তো নয়ই। মহিলাদের জীবন যাপন ছিল কলে পড়া জন্তুর মতন।সতীদাহ, বাল্যবিবাহ, বাল্যবৈধব্য, মাথা নীচু করে সমাজের পুরুষতান্ত্রিক সমস্ত রকমের অমানবিক অনুশাসন নারীকে মুখ বুজে মেনে নেওয়ার বাধ্যবাধকতা ছিল নারীর জীবনের অবশ্যম্ভাবীকতা, আবশ্যকিতা।
এহেন পরিস্থিতিতে আজ থেকে ১৪০ বছর আগে এই বাংলাতেই ঘটেছিল এক যুগান্তকারী ঘটনা।৷ আমাদেরই ঘরের দুই বঙ্গকন্যা সমাজের সমস্ত রকমের প্রতিবন্ধকতা সমুহকে সরিয়ে রচনা করেছিলেন এক ইতিহাস। অতিক্রম করেছিলেন সমস্ত রকমের প্রতিবন্ধকতা। ছিনিয়ে এনেছিলেন সফলতা।
আসুন ঘটনাটি জানার আগে আমরা জেনে নিই সেই দুই মহীয়সী নারীর পরিচয়। একজন হলেন ডাক্তার কাদম্বিনী বসু (গঙ্গোপাধ্যায়), আর আরেকজন হলেন চন্দ্রমুখী বসু।
কাদম্বিনী বসু (গঙ্গোপাধ্যায়)
জন্ম: ১৮ জুলাই, ১৮৬১, ভাগলপুরে,যদিও পৈতৃক বাড়ি ছিল বরিশালের চাঁদশী গ্রামে, এখন বাংলাদেশে।
মৃত্যু: ৩রা অক্টোবর, ১৯২৩,কলকাতায়।
বাবার নাম ছিল ব্রজকিশোর বসু। এই কাদম্বিনী বসু সারা বাংলা তথা ভারতবর্ষে তথা এশিয়ায় প্রথম মহিলা ডাক্তার।পাস করেছিলেন কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ থেকে। তার আগে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বেথুন কলেজ থেকে অন্যতমা প্রথম মহিলা স্নাতক (Graduate) হয়েছিলেন ১৮৮৩ সালে। পরে তিনি বিয়ে করেন দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়কে।এবং তিনি আমৃত্যু কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের সঙ্গে চিকিৎসক হিসাবে যুক্ত ছিলেন।
চন্দ্রমুখী বসু
জন্ম: ১৮৬০ সালে উত্তরপ্রদেশের দেহরাদুনে
মৃত্যু: ১৯৪৪ সালে, দেহরাদুনে।
বাবার নাম ছিল ভুবনমোহন বসু। ইনিও কাদম্বিনী বসুর সঙ্গে একসঙ্গে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বেথুন কলেজ থেকে এই বাংলায় তথা ভারতে, তথা এশিয়ার অন্যতমা প্রথম মহিলা স্নাতক (Graduate) হয়েছিলেন। পরে চন্দ্রমুখী বসু কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম একজন মহিলা হিসাবে ইংরাজিতে অনার্স নিয়ে এম.এ পাশ করেন। এবং বেথুন কলেজের অধ্যাপিকা ও অধ্যক্ষ হয়েছিলেন। অবসর নেওয়ার পরে তিনি দেহরাদুনের বড়িতে ফিরে যান।
এই দুই বঙ্গকন্যাকে ১৮৮৩ সালের ৫ই মার্চ,মানে আজকের দিনে, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেনেট হলে বাংলা তথা ভারতবর্ষের এবং এশিয়ার প্রথম মহিলা স্নাতক হিসাবে সম্বর্ধনা দেওয়া হয়েছিল। স্বয়ং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর চন্দ্রমুখী বসুকে চার্লস ক্লাউডেন্ ক্লার্ক-এর “শেক্সপিয়ার রচনাবলী ” এবং কাদম্বিনী বসুকে “মেডিক্যাল এনসাইক্লোপিডিয়া” উপহার দিয়েছিলেন সেদিন।
আজ আমাদের ঘরে ঘরে মেয়েরা কতো স্বাবলম্বী। কিন্তু আজ থেকে ১৪০ বছর আগে আমাদের এই বাংলায় শুধু নয়,সারা দেশে,সারা এশিয়া উপমহাদেশেই মেয়েদের এই আত্মানির্ভরশীলতার ক্ষেত্রে কি নিদারুণ নিষ্ঠুর প্রচন্ড বাধা প্রতিবন্ধকতা ছিল তা সহজেই অনুমান করা যায়। সেইসব বাধা,লোকজনের সমালোচনা, প্রশাসনিক অসহযোগিতা, সামাজিক অপমান, অবহেলাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে চন্দ্রমুখী বসু এবং কাদম্বিনী বসু গঙ্গোপাধ্যায়—এই দুই বঙ্গতনয়া সেদিন এক ইতিহাস তৈরী করেছিলেন এবং তার সামাজিক স্বীকৃতি অর্জন করেছিলেন তাঁরা আজকের এই ৫ই মার্চ তারিখে,আজ থেকে ১৪০ বছর আগে। এই সম্বর্ধনার সমাদরের ইতিহাস বাঙলা ও বাঙালির কাছে তো বটেই,সারা দেশের কাছে,এশিয়া উপমহাদেশের কাছে, সমগ্র মহিলা সমাজের কাছে এক ঐতিহাসিক মাইলফলক।