প্রথম পাতা প্রবন্ধ আধুনিক বিজ্ঞানের জনক এক মহা বিস্ময়কর বিজ্ঞানীর বিস্মৃত পরিচয়

আধুনিক বিজ্ঞানের জনক এক মহা বিস্ময়কর বিজ্ঞানীর বিস্মৃত পরিচয়

163 views
A+A-
Reset

পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়

সে আজ থেকে প্রায় হাজার বছরেরও বেশি সময়কালের কথা। এই বিশ্বের মাটিতে জন্মেছিলেন এক ক্ষণজন্মা প্রতিভার মানুষ, যাকে পরবর্তী সময়ে ইউরোপিয়ানরা “আল্ হাজেন্” বলে ডাকতেন,আর সেই মানুষটির জন্মভূমিতে তিনি ছিলেন “আল্ বসরি” বলে বিখ্যাত। কিন্তু তার আসল নাম ছিল “আবু আলি আল্ হাসান্ ইবনে আল্ হাইথাম্”।

তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১লা জুলাই, ৯৬৫ খ্রিষ্টাব্দে,ইরাক দেশের বসরা-তে। ধনী ঘরের সন্তান ছিলেন।প্রাথমিক, এবং উচ্চতর শিক্ষা তিনি গ্রহন করেছিলেন ইরাকের বাগদাদে। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি অত্যন্ত ধর্মপ্রাণ মানুষ ছিলেন। মুসলমানদের মধ্যে বিদ্যমান জাতিগত হিংসা, দ্বন্দ্ব, ইত্যাদি ইবনে আল হাইথাম-কে খুব কষ্ট দিত। তিনি মানতে পারতেন না সেইসব হিংসা, বিদ্বেষ পূর্ণ ক্রিয়াকলাপ।তিনি তাই মুসলমানদের মধ্যে আভ্যন্তরীণ শিয়া এবং সুন্নীদের এই হানাহানি,হিংসা,ইত্যাদির কারনগুলির অনুসন্ধানে গবেষণা করেছিলেন সেই সময়ের ইতিহাসের সমাজতত্ত্বের প্রেক্ষাপটে। গবেষণার ফল হিসাবে তিনি সিদ্ধান্ত নেন, এবং উল্লেখ করেন, যে এই পারস্পরিক দ্বন্দ্ব কখনোই সেই মহান আল্লাহ্-র বাণী সম্বলিত পবিত্র কুরআন থেকে উদ্ভুত হয়নি, তাসৃষ্টি হয়েছে মানুষের নিজস্ব ব্যক্তিগত স্বার্থপরতা, লোভ,কূপমন্ডুকতা, আর হিংসা থেকে। এই গবেষণার কারনে সমাজের এই অসমাধানযোগ্য সমস্যা হাইথামকে খুব পীড়িত করেছিল।এর পরেই তিনি সক্রেটিস, এরিস্টটল,প্লেটো,ইউক্লিড, আর্কিমিডিস, টলেমি,প্রমুখ দার্শনিকদের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন,এবং তাঁদের গবেষণা এবং দর্শনে তিনি নিজেকে নিমগ্ন করেছিলেন পড়াশোনাতে।

কর্মজীবনে প্রথমে তিনি বাগদাদ-বসরায় একজন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে কাজ শুরু করেন। অবশ্য কোনো কোনো ঐতিহাসিক বলেন তিনি ছিলেন বসরা-বাগদাদের অর্থমন্ত্রী। কিন্তু তিনি যে কাজই করে থাকুন না কেন,তিনি সেই কাজে সন্তুষ্ট ছিলেন না। তখনকার মিশর দেশের কায়রো-র শাসক খলিফা মুহম্মদ বিন আল হাকিম-এর আহ্বানে কায়রোতে চলে যান ১০১০ খ্রিষ্টাব্দে এবং অনেক বিশাল পরিসরে কর্মজীবন শুরু করেন।

কায়রোতে থাকাকালীন হাইথাম তাঁর শ্রেষ্ঠ গবেষণাপত্রটি “Book of optics” রচনা করেছিলেন। এ ছাড়াও হাইথাম তাঁর অমর কাজগুলি এই কায়রোতে থাকার এবং গবেষণা করার সময়েই রচনা করেছিলেন। সেইগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো –“Analysis and synthesis”, “Balance of Wisdom”, “Configuration of the World”, “Opskula”, “Motion of each seven planets”, Trities on light”, ” Trities on plans”, “The Resolution”,ইত্যাদি।

ফিজিক্সের (পদার্থ বিদ্যা) ওপরে ইবনে-র গবেষণা লব্ধ বই “কিতাব আল মানাজির” (Book of Optics) -কে আইজাক নিউটনের গবেষণা “Principia Mathematica”-র উৎস এবং পূর্বসুরী হিসাবে সারা বিশ্বের বিজ্ঞানীরা মনে করেন। হাইথামের এই বুক অফ অপটিক্স- ছিল সাত খন্ডের গবেষণা পত্র। এই বইয়ের গবেষণা পদার্থ বিদ্যার(Physics) আলোকবিজ্ঞানের সম্মন্ধে সমসাময়িক তো বটেই, পরবর্তীসময়ের বেশ কয়েক প্রজন্মের বিজ্ঞানীদের চিন্তা ভাবনায় আমুল পরিবর্তন নিয়ে এসেছিল। হাইথামের আবিস্কারের আগে অবধি বিজ্ঞানীদের,তথা এই বিশ্বের সকলের ধারণা ছিল যে,আমাদের চোখ থেকে বিচ্ছুরিত আলো কোনো বস্তুর ওপরে পড়লে,তবেই আমরা সেই বস্তুটিকে দেখতে পাই। এই ধারণাটি ছিল এরিস্টটলের। কিন্তু হাইথাম তার গবেষণায় বিভিন্ন বাস্তব যুক্তি দিয়ে দেখালেন যে এই ধারণা ভুল। যেমন,আমাদের অসীম অনন্ত আকাশে অনেক অনেক দুরের নক্ষত্রগুলো আমরা চোখ মেললেই দেখতে পাই,কিন্তু আমাদের চোখের আলো কতটা শক্তিশালী যে এতটা পথ এক মুহূর্তেই সেইসব নক্ষত্রগুলোর কাছে পৌঁছে যায়? ফলে,তিনিই এই বিশ্বে প্রথম ব্যক্তি যিনি ঘোষণা করেছিলেন, যে কোনো বস্তু থেকে বিচ্ছুরিত আলো আমাদের চোখের দৃষ্টিগোচরে এলেই আমরা সেই বস্তুটিকে দেখতে পাই। তিনি আলোকরশ্মির গতিপথ সরলরেখায় যে চলে,সেটিও প্রমান করেন প্রথম। স্নেলের সাইন সুত্রটিও তিনিই প্রথম আবিষ্কার করেন।পিনহোল ক্যামেরা,এবং পিনহোল অবস্কিউরার জনকও ছিলেন তিনি। তাই পরবর্তী সময়ে বিজ্ঞানী রজার বেকন, বিজ্ঞানী জোহান কেপলার, বিজ্ঞানী এলবার্ট আইনস্টাইন,বিজ্ঞানী টমাস আলভা এডিসন,প্রমুখ বিজ্ঞানীরা হাইথামের “Book of Optics” দ্বারা প্রবলভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। হাইথাম তার “Trities of light” রচনাতে আলোর প্রসরণ, আলোর বিচ্ছুরণ, আলোর প্রতিসরণ, রঙধনু,গ্রহন,বিবর্ধন কাঁচ, অধিবৃত্তিক কাঁচ, ইত্যাদি আলোকবিজ্ঞানের বিষয়গুলি নিয়ে আলোচনা করেন। শুধু তাই নয়,তিনি চোখের জৈবিক গঠন,এবং তার ব্যবচ্ছেদ প্রভৃতি বিষয়গুলি নিয়েও বিস্তৃত আলোচনা করেন

এছাড়াও তার অবদান রয়েছে এনাটমি (Anatomy) বা অঙ্গ ব্যবচ্ছেদ বিজ্ঞান,জ্যোতির্বিজ্ঞান (astronomy), গণিত (mathematics), চিকিৎসা বিজ্ঞান (medical science), চক্ষু বিজ্ঞান (opthalmology), প্রকৌশল বিদ্যা (engineering), পদার্থ বিজ্ঞান (physics), মনোবিজ্ঞান (Psychology), অর্থনীতি (Economics), দর্শন (Philosophy), বৈজ্ঞানিক গবেষণার পদ্ধতিগত উন্নয়ন (Programme and Process of development of Scientific Research), ইত্যাদি আধুনিক বিজ্ঞানের বিভিন্ন ধারায়।

এক কথায় বলা যায় এই বিশ্বে মানব সভ্যতায় এরিস্টটলের পরবর্তী হাজার হাজার বছরের বিজ্ঞানের ইতিহাসে এই বহুমুখী প্রতিভার মনস্বী বিজ্ঞানী দার্শনিক ইবনে আল হাইথাম ছিলেন পথিকৃৎ এবং আধুনিক বিজ্ঞানের জনক।

এহেন এক অবিস্মরণীয় প্রতিভার মানুষের ব্যক্তিগত জীবন সম্মন্ধে বিশেষ কিছু জানা যায় না। শুধু জানা যায়,ইবনে আল হাইথাম ৭৪ বছর বয়সে মিশরের কায়রোতে ১০৪০ খ্রিষ্টাব্দের ৬ই মার্চ তার জীবনের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

বিজ্ঞান গবেষণার সুউচ্চ স্তরে এই প্রতিভাবান বিস্ময় বিজ্ঞানীর বিষয়ে অনেকেই হয়তো কমবেশি জানেন,কিন্তু আপামর বিজ্ঞান মনষ্ক মানসিকতার মানুষের কাছে বিস্ময়কর মহা প্রতিভাশালী মানুষ এই ইবনে আল হাইথাম আজও উপেক্ষিত। ইতিহাসের বিস্মৃতির অধ্যায়ের অবহেলায় রয়ে গেলেন তিনি।এটাই সবচেয়ে বড় দুঃখের,বেদনার।

আরও খবর

মন্তব্য করুন

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

সম্পাদকের পছন্দ

টাটকা খবর

©2023 newsonly24. All rights reserved.