পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়
বাঙালির বারোমাসে তেরো পার্বণের শুরুটা হয় বাংলা নববর্ষের প্রথম মাস বৈশাখের পঁচিশে বৈশাখের দিন থেকে। যেদিন বাঙালির প্রাণের মানুষ রবীন্দ্রনাথের শুভজন্মদিন।
আচ্ছা সত্যিই কি রবীন্দ্রনাথকে আমরা আমাদের প্রাণের, অনুভবের তন্ত্রীতে তন্ত্রীতে গ্রহন করতে পেরেছি? সত্যিই কি আমরা আমাদের গৌরব অনুভব করি রবীন্দ্রনাথের জন্য? সত্যিই কি সম্মান করি তাঁকে প্রাণের মনের অঞ্জলি দিয়ে?
রবীন্দ্রনাথ চলে গেছেন(১৯৪১ সালের ৭ই আগস্ট) আজ হয়ে গেল ৮৫ বছর। বাঙালির জীবনে রবীন্দ্রনাথের ২৫ শে বৈশাখ তারপর থেকেই সার্ব্বজনীন হয়ে উঠলো। পালিত হতে লাগলো রবীন্দ্র- জন্মদিন। কিন্তু কখনো ভেবে দেখেছি কি যে এই ৮০/৮৫ বছর ধরে লালিত এক ঐতিহাসিক পালনীয় ধারাবাহিকতায় কি আমরা সত্যিই রবি ঠাকুরকে আমাদের দৈনন্দিন প্রাদেশিক, ব্যক্তিক, সাম্প্রদায়িক সঙ্কীর্ণতার বা কূপমন্ডুকতার নিকৃষ্ট গন্ডীগুলোর বাইরে রাখতে পেরেছি? রবি ঠাকুরের গান, কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, উপন্যাস, ইত্যাদিতে আমরা কি সত্যিই অনুসন্ধান করেছি আমাদের ভাষার, সংস্কৃতির মহানুভবতা, ষোলআনা বাঙালিয়ানাকে?
বেশ কিছুদিন ধরেই আমাদের চারপাশে শুধু ভাঙার খেলা চলছে,দেখা যাচ্ছে। কখনও বা ধর্মের নামে,কখনও বা জাত-পাতের নামে,কখনও ভাষার নামে,কখনও রাজনৈতিক দলের নামে মানুষকে ছোট ছোট গন্ডীর মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখে তাকে ভাবনা চিন্তায় ক্ষুদ্র করে দেওয়ার এক সুপরিকল্পিত প্রচেষ্টা চলছে। ফলস্বরূপ যেটা হচ্ছে,এক মানুষ আর এক মানুষের থেকে দূরে সরে তো যাচ্ছেই,তারসাথে,বুদ্ধি বিবেচনা লোপ পেয়ে তারা একে অপরের শত্রু হয়ে দাঁড়াচ্ছে। রবীন্দ্রনাথ বহু আগেই বাঙালি চরিত্র খুব ভালো করেই বুঝতে পেরেছিলেন। তাই তিনি “হিন্দু-মুসলমান ” প্রবন্ধে লিখেছেন- “বাংলদেশে আমরা আছি জতুগৃহতে,আগুন লাগাতে বেশিক্ষণ লাগেনা।” রবি ঠাকুরের দেখা বিশ শতক থেকে আমরা এখন অতি আধুনিক একুশ শতকের এক চতুর্থাংশ সময় অতিবাহিত করে ফেললাম,কিন্তু আমরা উন্নতি করতে পারলাম না নিজেদের। বরং আরও খারাপের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। তাই বাঙালির হাতের মারনাস্ত্র এখন বিদ্রোহের নামে ভাতৃহত্যা ঘটায়। প্রতিবেশী প্রতিবেশীদের ঘরে আগুন দ্যায়। সাম্প্রদায়িকতা আর রাজনৈতিক সংকীর্ণতা কূপমন্ডুকতা হীনমন্যতা র জন্ম দেয়। মানুষকে অমানুষ করে তোলে।
রবীন্দ্রনাথ বলছেন- “যদি অন্য কোনও বাঁধনে মানুষকে না বাঁধা না যায়,শুধু ধর্মের মিলেই মানুষে মিলে,তবে সে দেশ,জাতি হতভাগ্য। সে দেশ স্বয়ং ধর্মকে নিয়ে যে বিভেদ সৃষ্টি করে সেইটে সকলের চেয়ে সর্বনেশে বিভেদ..”
তিনি মুক্ত শিক্ষার প্রচারক ছিলেন।শিশু,বাল্য অবস্থায় শিক্ষাতে কোনও ধর্মীয় বিশ্বাসের বা প্রভাবের ছায়া যেন না পড়ে,তিনি তাই চেয়েছিলেন।কিন্তু আমরা বাঙালিরা কি করলাম? আমরা বাঙালি,বাংলা ভাষা আমাদের মা,আমাদের রবীন্দ্রনাথ নজরুল,এসব ভুলে গিয়ে আমরা বাঙালিকে ভাগ করলাম হিন্দুতে,মুসলমানে। তাই একদিকে শিশুদের জুটলো রামায়ন মহাভারতের গল্প,আর আর এক দিকে জুটলো মাদ্রাসা। জুটলো না ঠাকুরমার ঝুলি, বিভিন্ন মহাপুরুষদের ছোটবেলার শিক্ষার কাহিনীর সম্ভার। ফলে শিশু মনে অপর ধর্মের প্রতি উষ্মা, অসহিষ্ণুতার জন্ম হোতে লাগলো তা কারও ভাষায় “বদলা”, আবার কারোর ভাষায় “জেহাদ”। শিশুটি,বালকটি কিন্তু যথাযথ মানুষ হলো না।
তাই আজ বাংলা ভাষার মানুষই রবীন্দ্রনাথের মূর্তি ভাঙে,রবীন্দ্রনাথের গানে সাম্প্রদায়িকতার ছাপ ফেলতে চায়,খুঁজে বেড়ায় রবীন্দ্রনাথের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার মতো ক্ষুদ্রতাকে।আর এইসব কাজ করেন বাংলা ভাষাভাষীর মানুষরাই।
আজ যখন দেখি রবীন্দ্রনাথ নিয়ে এতো আবেগ,উদ্দীপনা, উচ্ছ্বাস,তা সত্ত্বেও রবীন্দ্রনাথের অনুরোধ, উপদেশ,ভাবনা চিন্তাগুলি রবি ঠাকুর-এর জন্মভুমিতেই নীরবে নিভৃতে কেঁদে চলেছে ধারাবাহিকতায়। অপমানে,উপেক্ষিত হয়ে আছে। তখন কষ্ট লাগে।
রবীন্দ্রনাথের সকল সৃষ্টির বহুল প্রচারে তো আমাদের বাঙ্গালী তথা ভারতীয় জাতি গঠনে সহায়তা হওয়ারই কথা ছিল,আদৌ তা হয়েছে কি? আমরা কি সম্মান দিতে পেরেছি রবীন্দ্রনাথকে? আমরা কি অন্তর দিয়ে গ্রহন করতে পেরেছি সার্ব্বজনীনতায় সকলেই সেই মহান মহামানবের চিন্তা ভাবনা গুলিকে?
কেন বাংলার মাটিতে আজও ধর্ম,সম্প্রদায়, জাতি,গোষ্ঠীতে এতো হানাহানি, রক্তক্ষয়ী সংঘাত? নিজের শুভবুদ্ধিকে না মেনে সব বিষয়ে পরশক্তির ওপর নির্ভরশীল বশংবদ হওয়া,পরের ভাবনা ও কাজের গোলামী করা বাঙালির অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে।
রবীন্দ্রনাথ এমন স্বভাবের উদাহরন দিয়েছিলেন ” শিক্ষার মিলন” প্রবন্ধে– একটি গ্রামের উন্নতিকাজ করতে গিয়ে গ্রামের মানুষকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘সেদিন তোদের পাড়ায় আগুন লাগলো, একখানা চালাও বাঁচাতে পারলি না কেন? তারা বললো–” কপাল”! তিনি বললেন ” কপাল নয়রে,কুয়োর অভাব! পাড়ায় একখানা কুয়ো দিস নে কেন?” তারা বললে-“আজ্ঞে কর্তার ইচ্ছে হলেই হয়..!”
একথা শুনে কবির স্বগতোক্তি ছিল,”আগুন লাগানোর, নেভানোর, বেলায় দেবতা,আর কপালে হাত। আর জল দেওয়া বা তার বন্দোবস্ত করার ভার কোনও এক কর্তার। এরা কোনও একটা দলের কর্তা পেলেই বেঁচে যায়; বাঙালির যত অভাবই থাক,এদের কোনও কালেই কর্তার অভাব হয়না।”
সেই কর্তাভজা রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীরাই আজ চারপাশে নানা খন্ডিত গোষ্ঠীর হর্তা-কর্তা-বিধাতা”। সেখানে কে রবি ঠাকুর, কী-ই বা তাঁর ভাবনা,সেসব আর জেনে বুঝে দরকার নেই,সব হুজুগে মেতে চলো।ভেঙে ফ্যালো ঐতিহ্য, ভেঙে ফ্যালো রবি ঠাকুরকে।এপার ওপার দুপারের বাংলায় আজ রবীন্দ্রনাথ অপমানে অপমানিত,অবহেলায় অবহেলিত। অবশ্য তাতে অধিকাংশ বাঙালির আর রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীদের কিচ্ছুটি যায় আসে না।
এখন এই রবীন্দ্রনাথের জন্মোৎসব পালনের আতিশয্যের মধ্যেই রবীন্দ্রনাথ ক্ষণিকের সম্মানের পরে অপমানিত হয়েই উপেক্ষিত হয়েই থাকেন,সাময়িক আদরে গ্রহনের পরে আর আমরা রবি ঠাকুরকে আমাদের দৈনন্দিন ব্যক্তিক সামাজিক নাগরিক জীবনে রাখিনা আপন করে,বরঞ্চ বলা যায়,অজান্তেই বোধহয় বর্জন করি।
এই আত্মপ্রবঞ্চনা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতেই হবে।না হলে আমাদের অস্তিত্ব হবে সমুহ বিপন্ন।
আসুন আমাদের রবীন্দ্রনাথকে আমরা আমাদের জীবনে মননে পরমাত্মীয় হিসাবে আপন করে নিই।