প্রথম পাতা প্রবন্ধ মির্জা গালিব কলকাতায় এবং কিছু সমসাময়িক কথা

মির্জা গালিব কলকাতায় এবং কিছু সমসাময়িক কথা

79 views
A+A-
Reset

পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়

তখন ৩০-৩২ বছর বয়স। কলকাতায় এসেছিলেন যৌবনের মির্জা গালিব।

প্রচণ্ড অভাব অনটন চলছে গালিবের। মোগল বাদশাহর অবস্থা খুবই খারাপ। ব্রিটিশ রাজ তখন ভারতবর্ষের দণ্ডমুণ্ডের মালিক। তার ওপর সারাদেশের রাজধানী তখন এই কলকাতা। সেই সময়ে ১৮২৮ সালের মার্চ মাসে ব্রিটিশ সরকারের কাছে বন্ধ হয়ে যাওয়া মাসোহারা ভাতা-র পুনরায় চালু করার আর্জি নিয়ে গালিব কলকাতায় এলেন। তিনি প্রায় দেড় বছর এই কলকাতার উত্তর অংশে সিমলা বাজারের কাছে ১৩৩ নম্বর হাবেলি-তে থাকতেন। যার এখনকার নাম হল রামদুলাল সরকার স্ট্রিট।

তাঁর বিখ্যাত “সফর্-এ-কলকাত্তাহ্ ” বইতে তিনি লিখেছিলেন সে সময়ের নানান অভিজ্ঞতার কথা। এখানকার সেইসময়কার বেশ কয়েকজন কবি(শায়র)দের সাথে পরিচিতও হয়েছিলেন তিনি।

যদিও যে উদ্দেশ্য নিয়ে গালিব কলকাতায় এসেছিলেন তা কিন্তু সফলকাম হয়নি। অত্যন্ত সাধারণভাবে, খুবই কষ্টের মধ্যে দিয়ে তার সেই সময়ের দিন কাটতো। তবু তিনি কলকাতাকে ভালোবেসেছিলেন, পঞ্চমুখে প্রশংসা করে তিনি লিখেছিলেন: …” কলকেত্তা কা জো জিকর্ কিয়া তুমে হাম নর্শী// এক তীর মেরে সীনে মে মারা কে হায় হায়.…”

গালিব প্রচণ্ড ভোগবাদী জীবন যাপন করতেন। কিন্তু কলকাতায় এসে তিনি সেই ভোগের মধ্যে এক ত্যাগী মানুষকে খুঁজে পেয়েছিলেন বোধহয়। যার পরিপ্রেক্ষিতে ৬৫/৭০ বছর বয়সে তিনি বন্ধু মির্জা হাতিম আলিকে লিখেছিলেন:..” মিছরির মাছির মতো হয়ে যাও, মধু-র মাছি হয়েও না…”।

ইতিহাসের সেই সময় কালটি ছিল অবিভক্ত বাংলা তথা অবিভক্ত ভারতবর্ষের নবজাগরণের প্রেক্ষাপট। আর সেই নবজাগরণের পীঠস্থান ছিল অবশ্যই এই কলকাতা। মির্জা গালিবকে বোধহয় এই প্রেক্ষিত অনুপ্রাণিত করেছিল। সব কিছুর ঊর্ধ্বে থেকে যায় যা, তা হল ভাবনা। ভোগী গালিবের মধ্যেই যেন আর একজন গালিবের জন্ম হয়েছিল। মিছরির মাছি হও, মধুর মাছি নয়…কি সমাপতন এই কথার মধ্যে, কারণ, এই কলকাতায় গালিবের অনেক আগে এসেছিলেন শ্রীচৈতন্যদেব, সাধক রামপ্রসাদ। অনেক আগে রক্তাক্ত মহাপ্রভু বলেছিলেন:..” মেরেছো কলসীর কানা, তাই বলে কি প্রেম দেবো না…” কি অসীম অতল ক্ষমাসুন্দর ক্ষমাশীল সহিষ্ণুতা। আবার সাধক রামপ্রসাদ গেয়ে উঠেছিলেন মনের একতারাতে…” মনরে কৃষিকাজ জানো না, এমন মানব জমিন রইল পতিত,আবাদ করলে ফলতো সোনা…”।

আবার গালিবের এই কলকাতার সফরের প্রায় ২০ বছর পরে কলকাতার উপকণ্ঠে দক্ষিণেশ্বরে বসে, সকলের চোখে এক “ক্ষ্যাপা পাগল”.. রাণী রাসমণিদেবীর প্রতিষ্ঠিত ভবতারিণীর মন্দিরে কালীমা-র দরবারে উপস্থিত গুণমুগ্ধদের বলছেন, প্যাঁকাল মাছের মতো হতে। ডুবে থাকো, গায়ে পাঁক মেখো না। সংসারে থেকেও শুদ্ধ, সৎ থাকা যায়। তাই থেকো। কি সহজ অথচ কি পরম অর্থবহ কথা। অনুভব করলে শরীরে রোমাঞ্চ হয়। পবিত্র হয়ে যায় অন্তঃস্থিত অন্তঃকরণ।

গালিবের লেখার সঙ্গে শ্রীরামকৃষ্ণ নিশ্চিত পরিচিত ছিলেন না। আবার গালিবও নিশ্চিত ভাবে শ্রীচৈতন্যদেব এবং সাধক রামপ্রসাদ-এর গান, লেখার সঙ্গে পরিচিত ছিলেন না। অপর দিকে মহাপ্রভু, রামপ্রসাদ বা রামকৃষ্ণদেবের জীবন যাপনের সঙ্গে গালিবের জীবন যাপনের বিস্তর ফারাক ছিল।

গালিব তো ছিলেন চরম ভোগবাদী। তবু তিনি জানেন ,মিছরির মিষ্টত্বটুকু গ্রহণ করতে হয়। মধুতে মিষ্টত্ব খুঁজতে গিয়ে তাতে জড়িয়ে পড়লে ডুবে যেতে হয়। এই যে গ্রহণ বর্জনের পালা, তাকে আয়ত্ত করতে হয়। দূরত্বে থেকে সবটুকু আত্মস্থ করার, চেখে নেওয়ার এই যে পরিমিতিবোধ, তা এই কলকাতাতেই গালিবের ভাবনায়,অনুভবে জন্ম নিয়েছিল। তিনি লিখেছিলেন:…” দিল্ আপকা কি দিল্ মে হ্যায়, জো কুছ্ সো আপকা..// দিল্ লিজিয়ে মগর্ মেরে আরমাঁও কো নিকাল্ কে…”।

মির্জা গালিব জন্মেছিলেন ১৭৯৭ সালের ২৭শে ডিসেম্বর, আর চিরবিদায় নিলেন ১৮৬৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারিতে। সিমলার কাছে জোড়াসাঁকোর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের তখন সবে ৮ বছর বয়স, আর সিমলার নরেন্দ্রনাথ দত্ত (স্বামী বিবেকানন্দ)-এর তখন মাত্র ছ’বছর বয়স। সে এক অন্য ইতিহাস।

প্রবল ভোগবাসনার মধ্যে, জাগতিক ভাবে জীবন যাপনের মধ্যেও এই এক উদাসীনতার নাম-ই হল মির্জা গালিব… প্রেমে হোক, জীবনে হোক…।

বড়ই অন্ত্যমিল শ্রীচৈতন্যদেবের, সাধক রামপ্রসাদ-এর অনেক পরে, এবং শ্রীরামকৃষ্ণদেবের দু’দশক আগের মির্জা গালিবের মধ্যে, ভাবনায়-চিন্তায়।

এ কি এই কলকাতার মাটির গুণ…? কে জানে…!

আরও খবর

মন্তব্য করুন

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

সম্পাদকের পছন্দ

টাটকা খবর

©2023 newsonly24. All rights reserved.