প্রথম পাতা প্রবন্ধ নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু এবং কিছু অজানা কথা

নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু এবং কিছু অজানা কথা

55 views
A+A-
Reset

পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়

সারাবিশ্বের ইতিহাসে রাষ্ট্রনায়ক হিসাবে একমাত্র নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুই হলেন সেই নিঃস্বার্থ, আপোষহীন মানুষ যাঁকে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি প্রচন্ডভাবে ভয় পেতো। সুভাষচন্দ্র-ই একমাত্র নেতা যিনি ছিলেন একজন প্রকৃত সাচ্চা দেশপ্রেমিক। স্বামী বিবেকানন্দের মন্ত্রশিষ্য নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুই একমাত্র বীর বিপ্লবী ছিলেন,যাঁর জীবনের অনেকটাই মানুষের কাছে আজও অজানা,অমীমাংসিত।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি গান বোধহয় নেতাজীর জন্যই সুপ্রযুক্ত –“তোমার আসন শূন্য আজি, হে বীর পূর্ণ করো,হে বীর পূর্ণ করো,হে বীর পূর্ণ করো”।

দেশত্যাগ করার পরে নেতাজী বিদেশের বহু জায়গাতে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের জন্য প্রবাসী ভারতীয়দের একসাথে সমবেত করেছিলেন দেশের কাজের জন্য,যদিও এই কাজ নেতাজীর আগে জাপানে রাসবিহারী বসু অনেকটাই সংগঠিত করেছিলেন।যাইহোক, নেতাজীকে পাশে পেয়ে প্রবীন রাসবিহারী বসু নেতাজীর হাতে সমস্ত দায়িত্ব অর্পণ করেন।নেতাজী তৈরী করেন আজাদ হিন্দ ফৌজ সেনাবাহিনী। যার সর্বাধিনায়ক হিসাবে সকলেই সুভাষ চন্দ্র কে নেতাজী রূপে অভিষিক্ত করেন। কারণ সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ভারতের স্বাধীনতা লুন্ঠনকারী ব্রিটিশ-এর বিরুদ্ধে নেতাজীই ছিলেন একমাত্র আপোষহীন রাষ্ট্রনায়ক।ব্রিটিশ শক্তিও নেতাজীকে সমীহ করত,ভয় পেতো।সেসব ইতিহাস সকলেরই জানা।

যাইহোক, ১৯৪৩ সালের ২১ শে অক্টোবর, সিঙ্গাপুরে নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর নেতৃত্বে তৈরী হয় প্রথম স্বাধীন মুক্ত ভারতের অস্থায়ী সরকার। উর্দুতে বলা হয় আর্জি হুকুমৎ-ই- আজাদ হিন্দ্ সরকার। এর থেকেই বোঝা যায়,তিনি কায়মনোবাক্যে,এবং সমস্ত কাজেই ছিলেন অসাম্প্রদায়িক একজন নেতা।একজন বিপ্লবী। একজন রাষ্ট্রনায়ক।

এই সরকারের রাষ্ট্রপতি,প্রধানমন্ত্রী, সমর ও পররাষ্ট্র বিষয়ের দায়িত্ব নেন স্বয়ং নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু। অন্যান্যরা হলেন,ডাঃ লক্ষী স্বামীনাথন(পরে লক্ষী সায়গল), এস.এ.আইয়ার,লেফটেন্যান্ট কর্নেল এ.সি.চ্যাটার্জি,লেফটেন্যান্ট কর্নেল আজিজ্ আহমেদ্,লেফটেন্যান্ট কর্নেল এন.এস.ভগত্, লেফটেন্যান্ট কর্নেল জে.কেভোঁসলে,লেফটেন্যান্ট কর্নেল গুলজারা সিং, লেফটেন্যান্ট কর্নেল প্রেম সেহগাল্্, লেফটেন্যান্ট কর্নেল শওকত্ মালিক,লেফটেন্যান্ট কর্নেল মহম্মদ জামাল কিয়ানি, লেফটেন্যান্ট কর্নেল এ.ডি.লোকনাথাম্, লেফটেন্যান্ট কর্নেল এহসান্ কাদির,লেফটেন্যান্ট কর্নেল শাহ্ নওয়াজ খান,প্রমুখ।

এছাড়াও, আজাদ হিন্দ সরকারের সংগঠন, প্রশাসন, বৈদেশিক সম্পর্ক বিষয়ে, পররাষ্ট্র বিষয়ে, ইত্যাদি বিষয়গুলিতে পরিচালনা করার জন্য নেতাজীর একাধিক সচিব এবং উপদেষ্টা নিযুক্ত ছিলেন,তাঁরা হলেন,– আনন্দ মোহন সহায়,সর্দার কর্তার সিং, এস. এ. পিল্লাই, ওয়াই.এস.ফুকন, করিম ঘানি, এ.এল্লাপ্পা, জে.থিভি, সর্দার ইসার সিং, এ.এন.সরকার, আবিদ্ হাসান্, হবিবুর রহমান্,প্রমুখজন।

এই তালিকা দেখলেই বোঝা যায় নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু ছিলেন একজন সম্পূর্ণ অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রনায়ক।

আজাদ হিন্দ সরকারের নিজস্ব ডাকটিকিট ছিল। আজাদ হিন্দ সরকারের নিজস্ব পতাকাও ছিল।আজাদ হিন্দ সরকারের নীতিবাক্য ছিল- “ইত্তেফাক্ (একতা), ইতমাদ্( বিশ্বাস) এবং কুরবানি (আত্মত্যাগ)। আজাদ হিন্দ সরকারের শ্লোগান ছিল “জয়হিন্দ্”। সেনাবাহিনীর কুচকাওয়াজ-এর গান ছিল-” কদম্ কদম্ বড়ায়ে যা,খুশীসে গীত্ গায়ে যা”।

প্রসঙ্গক্রমে একটি ইতিহাস এখানে উল্লেখযোগ্য,আর সেটা হোল,আজাদ হিন্দ সরকারের সংগঠন-এর প্রতি আকৃষ্ট হয়ে সিঙ্গাপুরে একটি ঘটনা ঘটেছিল,সেটাই এখানে রাখা হোল।সিঙ্গাপুরে দক্ষিণভারতীয় কট্টর হিন্দুবাদী চেট্টিয়ার সম্প্রদায়ের একটি বিরাট মন্দির ছিল। এখনও আছে।যাইহোক, সেই চেট্টিয়ার সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে তারা নেতাজীকে সসম্মানে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন মন্দিরে সম্বর্ধনা দেবার জন্য,এবং ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতাজীর এই আপোষহীন মনোভাব আর তার প্রতি সমর্থন জানিয়ে সাহায্য করার জন্য। নেতাজী মন্দির কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছিলেন যে,তাঁর মন্ত্রীসভায় হিন্দু,মুসলিম, শিখ,সব সম্প্রদায়ের মানুষ আছেন। সকলকে নিয়ে তিনি মন্দিরে সম্বর্ধনা নিতে যাবেন। কট্টরপন্থী হিন্দু সম্প্রদায়ের চেট্টিয়ারদের তরফ থেকে প্রথমে আপত্তি জানানো হয়।তার উত্তরে নেতাজী সেই সম্বর্ধনা ও সাহায্য প্রস্তাব, আমন্ত্রন প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।শেষে নেতাজীর সুদৃঢ় ব্যক্তিত্বের কাছে মাথা নত করতে হয় চেট্টিয়ার সম্প্রদায়ের নেতাদের। তারা ক্ষমা চেয়ে নেতাজীর প্রস্তাবেই রাজী হন।

এই ছিল নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর আপোষহীন, অসাম্প্রদায়িক চরিত্র। ভারতের স্বাধীনতা প্রাপ্তির সময়ে যিনি ব্রিটিশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন,সেই ক্লিমেন্স এটলি পরে,১৯৫৬ সালে ভারতে এসেছিলেন এবং একটি আলোচনায় খোলাখুলি ভাবে বলেছিলেন যে ব্রিটিশ নেতাজীকে অত্যন্ত ভয় পেতো।তাই নেতাজীর সেই আজাদ হিন্দ সেনাবাহিনীর পরাক্রমশালীতায় আর নেতাজীর অদম্য মানসিকতাকে ভয় পেয়েছিলেন।তাই তড়িঘড়ি করে অখণ্ড ভারতবর্ষ কে টুকরো টুকরো করে স্বাধীনতা নামক একটা প্রহসন ঘটিয়েছিলেন। এই সাক্ষাৎকারে ছিলেন সেই সময়ের পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল এবং কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি ফণীভুষন চক্রবর্তী।
(তথ্যসূত্র :-আনন্দবাজার পত্রিকা)।

নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর প্রতি তাই আমাদের এই উপমহাদেশের সমস্ত মানুষের চিরন্তন বিনম্র শ্রদ্ধা আজও বিদ্যমান।

তাঁর প্রতি রেখে গেলাম আমাদের বৈপ্লবিক অভিনন্দন, ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধা ও প্রণাম।

মন্তব্য করুন

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

সম্পাদকের পছন্দ

টাটকা খবর

©2023 newsonly24. All rights reserved.