প্রথম পাতা প্রবন্ধ “মা—মা গো…”

“মা—মা গো…”

911 views
A+A-
Reset

পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়

মা, মাগো, তোমাকে নিয়ে দু-চার কথা বলতে বড্ড ইচ্ছে করে,লিখতে ইচ্ছে করে,কিন্তু কি বলব?কি লিখবো? তুমি তো আমাদের সব বলার মধ্যে, সব লেখার মধ্যেই বিরাজ করে আছো। কারণ, তুমিই তো বলেছো,মা, –” মনে ভাববে,আর কেউ না থাক,আমার একজন “মা” আছেন।”

“মা”—এই শব্দটাই আমাদের প্রথম আর শেষ আশ্রয়,ভরসার স্থল। যেখানে নিখাদ ভালোবাসা মায়ের স্নেহের নকশীকাঁথায় যেন বিশ্বময়ী, বিশ্বমায়ের আঁচল পাতা। সেখানেই আমাদের সকলের পরম নিশ্চিন্ত আশ্রয়। সেখানে কোনো জাত-পাত নেই, নেই কোনো জাত-ধর্ম। সেই ঠাঁই সমস্ত দোষগুণ,পাপ-পূণ্যের ঊর্ধ্বে। সেখানে শুধু তুমি, মা গো শুধু তুমি।

যে সন্তান একটু কমজোরি, মা য়ের টান তার ওপরেই বেশী। তাই তো মাগো, তোমার আশ্রয়ে এসে দাঁড়ায় যত ব্রাত্যজনেরা,কুলি মজুর,চাষাভুষো, ফেরিওয়ালা, মুচি-মেথর,মেছুনি-জেলে,সংসার ত্যাগী সন্ন্যাসী, ডাকাত, বারাঙ্গনা, বীরাঙ্গনা, বিপ্লবীরা, বৃহন্নলা, এদেশের, বিদেশের, আরও কতো কতো অসহায় আতুরজনেরা। এসে দাঁড়িয়ে তোমাকে প্রণাম করে তোমার নরেন (স্বামী বিবেকানন্দ), কালী (স্বামী অভেদানন্দ), মহারাজ (স্বামী ব্রহ্মানন্দ), সারদা ( স্বামী ত্রিগুণাতীতা নন্দ), মহাকবি গিরিশ্চন্দ্র ঘোষ, মাস্টার শ্রী মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত (শ্রীম), গঙ্গা (স্বামী অখন্ডানন্দ), সুবোধ (স্বামী সুবোধানন্দ), তারক (স্বামী বিজ্ঞানানন্দ), উপেন (বসুমতী পত্রিকার স্রষ্টা), আমজাদ সরদার, গোপালের মা, সমাজ যাদের দূরে রেখেছিল, সেই চুণীবালা দাসী, কালীতারা দাসী, আবার সুদুর ইংল্যান্ড, আমেরিকা, ফ্রান্স, নরওয়ে প্রভৃতি থেকে আসা বিদেশীরা। আসেন সমাজের পন্ডিত মানুষরা, আসেন অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত বিপ্লবীরা,আসেন গৃহীভক্তরা।

সমাজের অবহেলিত,বা কোনো অন্যায় করে ফেলা মানুষ, যাদের সমাজ ‘দূর ছাই দূর ছাই’ করে, তারা কোথাও আশ্রয় না পেলেও, তোমার স্নেহের,ভালোবাসার আশ্রয়স্থল তাদের জন্য সবসময়ই উন্মুক্ত। তাদের জন্যই বিছানো আছে তোমার স্নেহের আঁচলখানি। এ তারা খুব ভালোভাবেই জানে।অন্তর দিয়েই বিশ্বাস করে।

তুমি মা সারদা..তুমিই জগন্মাতা।তুমি আমার মা,তুমিই আমাদের মা। তুমি সদাসর্বদা আমাদের জন্যে জেগে আছো। সেই যে সেই ঘটনা, কথামৃতকার শ্রীম মানে বিদ্যাসাগরের মেট্রোপলিটন স্কুলের মাস্টারমশাই মহেন্দ্রনাথ গুপ্তের ছাত্র ছিলেন বিনোদবিহারী সোম,(পরে নাম হয় পদ্মবিনোদ),তিনি সঙ্গদোষে পানাসক্ত হয়েছিলেন। মাঝরাতে আকন্ঠ নেশা করে বাগবাজারের বোসপাড়া লেনের মায়ের বাড়ির পাশ দিয়ে নেশার ঘোরে বকতে বকতে চলে যেতেন।একদিন রাতে ভিতর থেকে কোন আওয়াজ না পেয়ে বিনোদ গান ধরলেন,–“উঠগো মা করুণাময়ী, খোলো গো কুটির দ্বার,/আঁধারে হেরিতে নারি হৃদি কাঁপে অনিবার..”। গানের সঙ্গে সঙ্গে মায়ের জানালার কপাট খুলে গেল।পদ্মবিনোদ চোখের জলে আনন্দে নাচতে নাচতে বলে উঠলো, –” উঠেছো মা? এই অধম ছেলের ডাক শুনেছো? উঠেছো যখন, তখন এই ছেলের পেন্নাম নাও মা,পেন্নাম নাও..”। রাস্তায় গড়াগড়ি খাচ্ছে বিনোদ,আর মাঝরাতে গাইছে,–“যতনে হৃদয়ে রেখো আদরিনী শ্যামা মাকে,(মন),তুই দ্যাখ আর আমি দেখি,আর যেন কেউ নাহি দ্যাখে।” তারপরেই নিজেই নতুন শব্দ জুড়ে দিলেন– “আমি দেখি শুধু আমি দেখি,দোস্ত যেন নাহি দ্যাখে..”। এখানে উল্লেখ্য, এই ঘটনা জানা যায় স্বামী সারদানন্দের লেখা থেকে।আর বিনোদ বিহারী এই সারদানন্দকে “দোস্ত” বলে ডাকতেন। পরেরদিন,মাকে এভাবে ঘুম থেকে ডেকে তোলার জন্যে সবাই আপত্তি তোলায়,মা পরম স্নেহে বলেছিলেন–“আহারে বাছাকে আমার কিছু বোলনা তোমরা,ওর ডাকে যে আমি সাড়া না দিয়ে থাকতে পারিনে গো..”।

জয়রামবাটির পাশের গ্রামের লালু মানে লালুরাম মাজী গেছে আরামবাগে জমিদারবাড়িতে পালাগান গাইতে দুর্গাপূজার সময়ে।মহানবমীর দিন সকাল থেকে বসবে আসর।ভোরবেলায় লালুর গ্রাম থেকে খবর এলো, ‘এক্ষুনি বাড়ি যাও। বাড়িশুদ্ধু সকলের বসন্তে মরমর অবস্থা..”।জমিদারবাবু শুনে বললেন,”এক্ষুনি,বাড়ি যা লালু।সামনে বছর গান গাইবি।এখন বাড়িতে যা..”।
ছুটলো লালু। মনে মনে শুধু ভাবছে,আর বলছে,”বাড়ি গিয়েই কি অবস্থা দেখেশুনে,তারপরই যেতে হবে পিসিমার কাছে।পিসিমা পেসাদি ফুল দিয়ে দিলেই সব ঠিক হয়ে যাবে..”।

কিন্তু হায়,পিসিমার বাড়ি গিয়ে লালু শোনে,যে পিসিমা কলকাতায়। মনে মনে খুব অভিমান নিয়েই আপনমনে বলে ফেলল লালু,’এই সময়ে তুমিও কলকাতায়? এখন আমাকে কে উদ্ধার করবে? কে আছে আমার তুমি ছাড়া..? এইযে সবাই বলে তুমি নাকি সব্বোজয়া মা সিংহিবাহিনী…আর সেই তোমার কি’না এমনতর বিচার..?”

লালু বাড়ির দিকে ছুটছে,আর হাপুসনয়নে কেঁদে চলেছে। বাড়ি পৌঁছাতে সন্ধ্যে গড়িয়ে গিয়েছে।গিয়ে দেখে বউ,সন্তান সব রোগে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে।লালুও খুব ক্লান্ত, সেই ভোরেরবেলা আরামবাগ থেকে পায়ে হেঁটে আসা এতোদুর…তারওপর পিসিমাও নেই…একসময়ে লালু ঘুমিয়ে পড়লো। কতক্ষণ ঘুমিয়েছে কে জানে,স্বপ্নে লালু দেখছে, ঘরের ভেজানো দরজা খুলে মাথার কাছে এসে দাঁড়িয়ে পিসিমা বলছে–“কিরে,খুব অভিমান করেছিস,আমি নেই বলে? এই তো আমি এয়েছি। চিন্তা করিসনি,সব ঠিক হয়ে যাবে। বউমাকে, নাতিকে, নাতনিকে দেখে নিয়েছি,পেসাদির ফুল রেখে গেলাম…এইনে ধর…”। লালুর এক চটকায় ঘুম ভেঙে গেল।দেখলো,সত্যিই ঘরের দরজা দিয়ে ভোরের আলো, আর দেখলো রোগীর বিছানাতে মাথার শিয়রে রয়েছে প্রসাদীফুল। লালুর দুচোখে কান্নার আনন্দধারা বইছে তখন দুকুল ছাপিয়ে সাত সমুদ্র তেরো নদীর স্রোতধারার মতন।

মহা বিপ্লবী, ঋষি শ্রীঅরবিন্দ জায়া মৃণালিনী দেবী এসেছেন মায়ের বাগবাজারের বাড়িতে,—“মা,আমার স্বামীর কি হবে?” মায়ের পরম স্নেহের উত্তর–“আমার ছেলে তো ঠাকুরের সন্তান।ওতো দিব্যপুরুষ,ওকে কেউ আটক রাখতে পারবেনি…,বউমা তুমি একটুকুও চিন্তা কোরনি গো।”বুকে টেনে নিলেন মৃণালিনীকে।সাক্ষী রইলেন শ্রী অরিবিন্দের সাথী বিপ্লবী দেবব্রত ঘোষ,তার বোন সুধীরা ঘোষ,ভগিনী নিবেদিতা,জোসেফিন ম্যাকলাউড(স্বামী বিবেকানন্দের শিষ্যা),মিসেস সারা ওলি বুল(স্বামী বিবেকানন্দ “সারি-মা” বলে ডাকতেন),স্বামী সারদানন্দজী। শ্রী অরবিন্দ জেল থেকে মুক্তি পেয়ে সোজা বাগবাজারে শ্রীমাকে প্রণাম করে চন্দননগরে চলে যান।তারপর পন্ডিচেরী।

“ওরে তোরা রেলগাড়ী থামা,ছেলেটা আমার গাড়ি ধরবে বলে ছুটছে…”। স্বামী সারদানন্দ লিখছেন.. “বাগনানে স্টেশনে গাড়ি থামলো,গাড়িতে উঠলেন এক লম্বাচওড়া যুবক…কন্ঠে তার ডাক ” মা কোথায়, মা, আমার, মা কোথায়…? “

মা সাড়া দিলেন–“এইতো আমি,এসো বাবা এসো…।” যুবকটি মায়ের পায়ের কাছে বসে প্রণাম করে বলে উঠলেন,–“মা আশীর্বাদ করো,সাদা বাঁদরগুলোকে তাড়াতে যাচ্ছি।ওদের যেন তাড়াতে পারি..”। মায়ের উত্তর–“ঠিক সফল হবে বাবা,ওরা আর বেশিদিন এদেশে নেই,পালাবে সব ছেড়েছুড়ে..”। এই যুবকের নাম যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় (বাঘা যতীন)।

জয়রামবাটির কাছে কোয়ালপাড়াতে মা থাকতেন মাঝেমধ্যে।সেখানে আশ্রয় পেতেন এদেশের আত্মগোপন করে থাকা বিপ্লবীরা। মা তাঁর সন্ন্যাসী সন্তানদের আর বিপ্লবী সন্তানদের নাম ধরে ডাকতেন না,ডাকতেন “দেবশিশু ” বলে।
মা কোনো জাত-ধর্ম মানতেন না।সকলেই জানেন সেই আমজাদ ডাকাতের কাহিনী,যাকে মা নিজে পরিবেশন করে সামনে বসিয়ে খাওয়াতেন,আর নিজেই আমজাদের এঁটোপাতা তুলতেন।

জয়রামবাটির কাছেই শিরোমনিপুর।সেখানকার মুসলমানদের মধ্যে অনেকেই পেটের জ্বালায় অসৎপথ ধরেছিল,মা তাদের কাছে ডেকে,বুঝিয়ে সুঝিয়ে স্বাভাবিক পথে নিয়ে আসেন।তারা সকলেই রোজ মায়ের কাছে আসতেন,তাদের বাড়ির মেয়েরাও মায়ের কাছে আসতেন দল বেঁধে।

মিস মারগারেট নোবেল (তখনও ভগিনী নিবেদিতা হননি),মিসেস সারা ওলি বুল,মিস জোসেফাইন ম্যাকলাউড প্রথমবার দেখা করতে এসেছেন মায়ের সাথে বাগবাজারের বোস পাড়া লেনের বাড়িতে। এনারা বিদেশী,মা সেই যুগের এ দেশের এক গ্রাম্য-রমনী,কিন্তু কি আশ্চর্যজনক ব্যাপার,… স্বামী বিবেকানন্দ বলছেন স্বামী রামকৃষ্ণানন্দকে–“দেখলুম,মা যেন এই বিদেশীনীদের কতো আপন,কতো পরিচিত,তাদের সঙ্গে বসে একথালাতে মুড়ি,নারকেল নাড়ু,মুড়কি,বাতাসা খাচ্ছেন,আর মাঝে মধ্যেই বলছেন, ‘খাও বাছারা,খাও খাও..’, আমি তো দেখে শুনে একেবারে অবাক। তোরা জানিস না,মা কি জিনিস..,মা যে সাক্ষাৎ জগজ্জননী।আমাদের জ্যান্ত দুর্গা…”।

মায়ের পোষা চন্দনা পাখি ছিল,নাম গঙ্গারাম।মায়ের স্নেহের ছায়ায় থাকতো অসংখ্য বেড়াল, কুকুর, হাস, পায়রা, কাকেরা, গরু, ছাগল,প্রভৃতি। এরা সকলেই ছিল মায়ের সন্তান।মায়ের করুণায় এদের সকলের বসবাস।

মা এসেছিলেন মহিমাময়ী লীলার জন্য এই বাংলার জয়রামবাটির রামচন্দ্র মুখুজ্যে আর শ্যামাসুন্দরী দেবীর ঘরে ৮ই পৌষ,১২৬০ বঙ্গাব্দ (ইং- ২২শে ডিসেম্বর, ১৮৫৩)। মায়ের প্রথমে নাম ছিল ক্ষেমঙ্করী।রাশনাম ছিল ঠাকুরমনি দেবী।পরে নাম রাখা হয় সারদামনি। মায়ের সাথে পরমপুরুষ শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের বিবাহ হয়েছিল ১৮৫৯ সালে। মা ১৮৭২ সালের ২৩ শে মার্চ দক্ষিণেশ্বরে আসেন।ছিলেন ১৮৮৫ সাল অবধি। ১৮৮৬ তে ঠাকুরের মহাপ্রয়াণের দুমাস পরে মাকে তীর্থভ্রমণে নিয়ে যাওয়া হয়।ফিরে এসে কামারপুকুরে ছিলেন খুবই দারিদ্রের সঙ্গে অসহায়ের মতো।এই কথা স্বামী বিবেকানন্দ সহ ঠাকুরের সন্ন্যাসী ও গৃহীভক্তদের গোচরে আসার পরে বাগবাজারে ১৬/১৭ নং বোসপাড়া লেনের একটি জরাজীর্ণ পুরানো বাড়ি প্রথমে ভাড়ায়,পরে কেনা হয়,এবং মা সেখানেই থাকতে শুরু করেন। এখানেই দেশের বিদেশের ভক্তরা আসতেন মায়ের কাছে সান্নিধ্য পাবার ইচ্ছায়।
১৩২৭বঙ্গাব্দের ৪ঠা শ্রাবণ(ইং-২০শে জুলাই,১৯২০সাল) রাত দেড়টায় মা তাঁর নরদেহ ত্যাগ করে শ্রীরামকৃষ্ণলোকে চিরবিদায় নেন।

কিন্তু মা– চিরকালের মা,আমাদের সকলের মা–এই বিশ্বের দুঃখী ভারাক্রান্ত জীবের কথা সেদিনও মা বিস্মৃত হননি।তাই চিরবিদায়ের কয়েকদিন আগেই চিরকল্যাণময়ী শ্রীমা সারদা অতি করুণার্দ্রকণ্ঠে বলেছিলেন–” যারা এসেছে,যারা আসেনি,আর যারা আসবে,আমার সকল সন্তানদের জানিয়ে দিও মা,–আমার ভালোবাসা,আমার আশীর্বাদ সকলের ওপর আছে।আমি তোমাদের মা হয়েই আছি তোমাদের কাছে,থাকবোও চিরকাল।”

তাই আমাদের মা আছেন।আমাদের ঘরে বাইরে,অন্তরে অন্তরে তিনি আছেন।মায়ের শুভ জন্মতিথি অতিবাহিত হোল।সে উপলক্ষে রেখে গেলাম আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধা এবং প্রণতি।

(তথ্য ঋণ– সারদা- রামকৃষ্ণ /দুর্গাপুরী দেবী,শ্রীশ্রী সারদেশ্বরী আশ্রম,কলিকাতা,(১৩৬৮বাং,/১৯৬১ইং)/পৃ-৪০৯-১০,৪২৪।
শতরূপে সারদা।)

মন্তব্য করুন

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

সম্পাদকের পছন্দ

টাটকা খবর

©2023 newsonly24. All rights reserved.