পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়
পৃথিবীতে এমন অনেক ঘটনাই ঘটে,আমরা বুদ্ধি দিয়ে যার কোনও ব্যাখ্যা করতে পারি না। সেই নিয়ে তর্ক- বিতর্ক চলতে পারে বহুদুর,কিন্তু কোনও সঠিক উপসংহার টানা যায়না। তাই সেইসব বিষয়ে আমাদের একমাত্র ভরসা হলো বিশ্বাস।এইরকম বিশ্বাস দিয়েই আমরা আমাদের জীবনের অনেক কিছুই গ্রহণ করি, সেটাই আমাদের অভ্যাস। আজ এখানে সেই অনির্বচনীয় পরম বিশ্বাসের কিছু অজানা কাহিনী উপস্থাপন করা হলো।
জগজ্জননী বিশ্ববরণীয়া শ্রীশ্রীমা সারদা দেবীকে তাঁর পূণ্য-পবিত্র জন্ম-মুহুর্তে সর্বপ্রথম মাতৃগর্ভ থেকে এই বিশ্বচরাচরে প্রথম আলো যিনি দেখিয়েছিলেন,– তিনি ছিলেন সেই সময়কালের তথাকথিত সমাজের অস্পৃশ্য জনগোষ্ঠীর এক প্রতিনিধি,নাম ছিল শ্রীমতী ভুবন হাড়ি। এই সম্প্রদায়ের পদবী ছিল “হাড়ি”। আমাদের সমাজে প্রচলিত যে শব্দ আমরা শুনে আসছি “হাড়ি-বাগদি”-দের কথা–সেই হাড়ি সম্প্রদায়ের মানুষ ছিলেন এই মহিলা–ভুবন হাড়ি।
বাংলার পূণ্য পীঠস্থান বাঁকুড়া জেলার শিরোমণিপুর থানার অধীনে মসিনাপুর গ্রাম।শ্রীশ্রী মায়ের জন্মস্থান পূণ্যভূমি জয়রামবাটির দক্ষিণ পশ্চিমের কোণে ছিল এই মসিনাপুর গ্রাম–যা আজও আছে। এই গ্রামের হরিহরপাড়ার নামডাক ছিল একসময়ে খুব।জয়রামবাটি,হলদি,জিবেট, সাতবেড়ে,ইত্যাদি, এমন বহু গ্রামেই। এই মসিনাপুর গ্রামের হরিহরপাড়ার সেই হাড়ি-বউ–ভুবন হাড়ির ডাক পড়তো এইসব এলাকার গ্রামগুলোতে সকল সন্তানসম্ভবা মায়েদের প্রসবক্রিয়ার কাজ সমাধা করার জন্য। এই ভুবন হাড়ি-“ধাই-মা” বা “ধাত্রী-মা” বলে পরিচিতা ছিলেন সেই অঞ্চলে।
শ্রীশ্রী মা সারদা দেবী এবং তাঁর ভাইদের ধারী-মা ছিলেন এই ভুবন হাড়ি। হরিহরপাড়ার বাসিন্দা সুখলাল হাড়ির স্ত্রী ছিলেন ভুবন হাড়ি। শ্রীশ্রী মা সারদা-র ধাই-মা(ধাত্রী-মা) ভুবন দেবীর গায়ের রঙ ছিল ফর্সা, চেহারা ছিল দোহারা চেহারার, এবং অত্যন্ত স্নেহশীলা এই মানুষটির কথাবার্তাও ছিল খুব মোলায়েম আর সুন্দর।
ধাত্রী-মা এই ভুবন হাড়ি শ্রীশ্রী মা সারদার সেই শুভ মহাক্ষণ জন্মমুহূর্তের একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী ছিলেন,এবং সেদিন সেইমুহুর্তে,সেই সদ্যোজাত শিশু(শ্রীশ্রীমা সারদার)-র দৈবসত্তার দর্শন পেয়ে তিনি কৃতার্থও হয়েছিলেন। পরে সেই অভিজ্ঞতার কথা ও কাহিনী ভুবন হাড়ি তাঁর একমাত্র কন্যা চারু হাড়ি-কে প্রায়শই বলতেন — “জয়রামবাটির রাম মুখুজ্জ্যের মেয়ে সারু(ভুবন হাড়ি এই নামেই শ্রীমা-কে ডাকতেন) যে আর পাচঁটা সাধারণ মেয়ে নয় সেটা আমি ওর জম্মের সময়েই টের পেয়েছিলুম।সারু-কে যখন তার মায়ের পেট থেকে বের করি,তখন মনে হলো যেন একটা আলোর তাল আমার দুটো হাতে এলো। আমার চোখ বুজে এলো,ধাঁধিয়ে গেল চোখদুটো। তারপর ভালো ক’রে ধুইয়ে মুছিয়ে দেখি–নাঃ, –টুকটুকে মেয়েই হয়েছে।তখন আমি ভাবলুম,হয়তো আমার চোখের ভুল।”
“তারপর যখন একুশ দিন কাটলো, তখনও সেই মেয়ের নাড়ির সুতোটা শুকোয় নি।আমি তেল মালিশ কোরে দোবো ব’লে যেই কোলে তুলেছি,তখনও দেখি তার জম্মাবার সময়ের মতন আমার কোলে যেন একটা সোনার আলোর তাল। খুব ভয় পেয়েছিলুম, চোখ বুজে মা-কালীর স্মরণ নিলুম।পরে চোখ খুলে দেখি,খুদে মেয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।সেদিনই বুঝেছিলুম এ মেয়ে যে-সে মেয়ে নয়। ও খুব বড় হবে। সারু-র জম্মের পরেই তো ওর বাপের বাড়-বাড়ন্ত হলো,-জমি জিরেত হলো। আমি তো অনেকদিন ধরেই জয়রামবাটিতে কাজ করছি,সব বাড়িরই অবস্থা আমার সব জানা। সারু বড় হলে ওদের বাড়িতে যখন যেতুম,সে বলতো –” দাই-মা, এসো এসো,বোসো বোসো..”.। আসন পেতে দিত,হাতের কাছে যা ফল-মিঠাই থাকতো, আমাকে যত্ন করে খেতে দিতো। বলতো–” খাও দাই-মা,খাও…”। আমি কিন্তু তাকে দেখলেই বলতুম–“পেন্নাম মা নক্ষী”। সে অমনি বলতো–“দাই-মা, আমি তোমার চেয়ে কতো ছোট,আমাকে পেন্নাম জানাও কেন?”আমি বলতুম– “মা-রে,তুই যে মা নক্ষী..,মা-নক্ষীকে পেন্নাম না জানালি হয়?” তক্ষুনি সারু বলতো–” অমন কতা বলো না, আমি তোমাদের সেই সারু-ই গো সেই সারু-ই..”,বলেই ছুট্টে পালিয়ে যেত..”।
ভুবন হাড়ির মেয়ে চারু হাড়ি অনেকদিন বেঁচেছিলেন। তাই জয়রামবাটির সব বাড়িতেই তার যাতায়াত ছিল। শ্রীমায়ের ভাইপো ভাইঝি-দের ধাত্রীমা ছিলেন এই চারু হাড়ি।চারুর পরে তার মেয়ে কমলা,এই ধাত্রী মায়ের কাজ করতেন। চারু হাড়ির নাতনী ভরী হাড়ির মেয়ে প্রবীনা গীতা হাড়ি(দে) এইসব তথ্য জানিয়েছেন।
আজও হরিহরপাড়ায় ভুবন হাড়ির বাড়িতে শ্রীশ্রী মায়ের নিত্যপূজা হয়–এই বিশ্বাসে যে,জগজ্জননী শান্তিময়ী শ্রীশ্রী মায়ের জাগতিকভাবে শুভ আবির্ভাবের প্রথম সাক্ষী যিনি ছিলেন তিনি মানে,এই ভুবন হাড়ি, আর কেউ ন’ন,তিনি ছিলেন মহামায়া মহাশক্তির দশম ধাত্রী-র অন্যতম ধাত্রী–“আরাত্রিকা”।
শ্রীমা সারদা -র আর একটি অজানা কাহিনী এখানে উল্লেখ্য। দক্ষিণেশ্বরে রানী রাসমণি দেবী দুটি নহবত তৈরী করিয়েছিলেন,একটি দক্ষিণ দিকে,আরেকটি উত্তর দিকে।রানী রাসমণী দেবীর অন্তরের ইচ্ছা ছিল দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে মা ভবতারিণীকে ভারতীয় সঙ্গীতের বিভিন্ন রাগ-রাগিনী শোনাবার।তাই এই দুটি নহবতখানা।
শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব-এর মা চন্দ্রমণি দেবী এবং ঠাকুরের লীলাময়ী লীলা সঙ্গিনী শ্রীমা সারদা দেবী যখন দক্ষিনেশ্বরে থাকতেন,তখন তাঁদের থাকার জায়গা ছিল উত্তর দিকের এই নহবতের ঘরে।দক্ষিণ দিকের নহবতখানা থেকে সানাই,নাগারা বাজানো হতো। তখন। যদিও শ্রীমা, যে নহবতের ঘরটিতে থাকতেন,তার বিবরণ থেকেই আমরা বুঝতে পারব যে শ্রীমা কত অমায়িক কষ্ট সহিষ্ণু ছিলেন,যা আমাদের চিন্তা ভাবনার অতীত। আসুন, জেনে নিই সেই নহবতখানার ঘরটির সাইজ।ঘরের দৈর্ঘ্য এবং প্রস্থ ছিল সমান– ৭ফুট ৯ ইঞ্চি।উচ্চতা ছিল ৯ ফুট ৩ ইঞ্চি। ঘরের যাতায়াতের দরজাটি ছিল ২ ফুট ২ ইঞ্চি চওড়াতে আর উচ্চতা ছিল ৪ ফুট ২ ইঞ্চি। শ্রীরামকৃষ্ণ ছিলেন উচ্চতায় ৫ফুট ৯ইঞ্চি,আর শ্রীমা ছিলেন আনুমানিক ৫ফুট ৫ ইঞ্চি। ভাবা যায়,ঐ ৪ফুট ২ ইঞ্চির উচ্চতার দরজা দিয়ে শ্রীমা যাতায়াত করতেন।
শ্রীমায়ের আত্নকথা থেকে জানা যায়,–” প্রথম প্রথম ঘরে ঢুকতে মাথা ঠুকে যেত।একদিন তো কেটেই গেল,শেষে বেশ অভ্যেস হয়ে গিছল। দরজার সামনে গেলেই মাথা নুইয়ে আসতো। কলকাতা হতে সব মোটাসোটা মেয়েলোকেরা দেখতে যেতো,আর দরজার দু’দিকে হাত দিয়ে বলতো,-আহা, কি ঘরেই আমাদের সতীলক্ষ্মী আছেন গো–যেন বনবাস গো…”।
নহবতের সম্মন্ধে শ্রীমা আরও বলেছিলেন,–“(নহবতের) নীচের একটু খালিঘর,তা আবার জিনিসপত্রতে ভরা।মাথার উপরে সব শিকে ঝুলছে।রাতে শুয়েছি,মাথার উপরে মাছের হাঁড়ি কলকল করছে–ঠাকুরেরজন্যে শিঙ্গিমাছের ঝোল হতো কি’না।”
শোবার বিছানা কিরকম ছিল,বলতে গিয়ে মা বলছেন –” ঠাকুর কতকগুলি পাট এনে আমায় দিয়ে বললেন– “এগুলি দিয়ে আমায় শিকে পাকিয়ে দাও,আমি সন্দেশ রাখবো, লুচি রাখবো, ছেলেদের জন্যে।” আমি শিকে পাকিয়ে দিলুম,আর পাটের ফেঁসোগুলো দিয়ে থান ফেঁড়ে মাথার বালিশ করলুম। চটের উপর পটপটে মাদুর পাততুম আর সেই ফেঁসোর বালিশ মাথায় দিতুম।”
ভাবলে,সত্যি অবাক হয়ে যেতে হয়,কি কৃচ্ছসাধন। জগন্মাতা জগতের জননী যিনি,তিনি কোনও রকমে সম্পূর্ণ অনাড়ম্বর এক জীবন কাটিয়েছেন তাঁর জীবদ্দশায়। ঠাকুর তাঁর ইহজগতের লীলান্তের কিছু আগে শ্রীমাকে বলেছিলেন, তিনি শরীর ছেড়ে চলে যাবার পরে শ্রীমা যেন কামারপুকুরের মাটির ঘরে চলে যান,শাক বুনে,সেই শাক দিয়ে মোটা চালের ভাত যেন খান। শ্রীমা তাই করতেন।
যদিও পরে তাঁর সন্ন্যাসী ও গৃহী সন্তানরা (স্বামী বিবেকানন্দ, স্বামী সারদানন্দ,স্বামী ব্রহ্মানন্দ, বলরাম বসু,মীলমণি মুখোপাধ্যায়, প্রমুখদের উদ্যোগে শ্রীমায়ের জন্য প্রথমে বেলুড়ে একটি ভাড়া ঘর,এবং পরে কলকাতার বাগবাজারে ১৬ নং ঘোষ পাড়া লেনে একটি ছোট বাড়ির ব্যবস্থা করা হয়।পরে পাশের ১৭ নং টিও কিনে নেওয়া হয়।সেখানেই শ্রী মা থাকতেন,ভগিনী নিবেদিতাও থাকতেন(যখন শ্রীমা কলকাতায় থাকতেন)। সেটি এখন শ্রীরামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের উদ্বোধন কার্যালয়।
এখানেই শ্রীমায়ের অসাধারণত্ব।মায়ের অনুযোগহীন,অভিমানহীন, অনাড়ম্বর জীবনে একটাই পরমব্রত ছিল,সেটা হলো মানুষের কল্যান করা,মানুষের সেবা করা,তাঁর সন্তানদের দুঃখে কষ্টে তাদের মাতৃস্নেহে নিজের কাছে পরমাত্মীয়ের মতো টেনে নেওয়া, মা-হিসাবে তাদের পাশে থাকা। সেখানে ছিলনা কোনও জাত-ধর্ম, জাত-পাত ধণী গরীবের বাছবিচার।ছিলনা কোনও রকমের ভেদাভেদ জ্ঞান,ছিলনা কোনও প্রকারের উন্নাসিকতা।আর নিজের জীবন যাপন দিয়ে সেই শিক্ষা এবং আদর্শই তিনি প্রতিষ্ঠা করে গেছেন আমাদের কাছে।যা আমাদের কাছে এক স্মরণীয়, বরনীয়,অনুসরণীয় এবং গ্রহণীয় ঐতিহাসিক দৃষ্টান্তের অমৃতকথা ও কাহিনী।
শ্রীমা– তোমায় প্রণাম,প্রণাম,প্রণাম।