পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়
” ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুরই অন্তরে…”(কবি গোলাম মোস্তাফা).. এই কথাটিকেই যদি আমরা আরও বড়ো করে দেখি তাহলে বলতেই পারি যে… লুকিয়ে থাকে আগামী মাতা সকল কন্যাশিশুর অন্তরে, আর ঘুমিয়ে থাকে আগামী পিতা সকল পুত্র শিশুর অন্তরে।
সত্যিই তাই,আজকের সমস্ত শিশুই আগামী ভবিষ্যতের সকল ক্ষেত্রের নাগরিক। মানব সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কাণ্ডারী।
সারা বিশ্বেই তাই আজকের যারা শিশু তাদের প্রতি আন্তরিক ভাবে আদর যত্নে লালিত পালিত করার দায়িত্ব সামাজিকভাবে গৃহীত এবং অবশ্যই পালনীয়। অনেক দেশে এমনও আইন আছে যে, যেখানে শিশুদের প্রতি সামান্য কোন অনাদর অবহেলা হলে তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসাবে ধরা হয়। আর তার বিচার হয়।
কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় যে উন্নত, অতি উন্নত দেশ গুলি ছাড়া বিশ্বের অনুন্নত,গরীব দেশের শিশুরা আজও অনেক ক্ষেত্রে অযত্নে,অবহেলায়,অনাহারে,অশিক্ষায়,গৃহহীন,অস্বাস্থকর অবস্থাতে দিন কাটায়। তাদের অনেককেই পেটের জ্বালায় শিশু শ্রমিক হিসাবে কাজ করতে হয়। শিশু কন্যারা অসময়ে হারিয়ে যায় তাদের ঠিকানা থেকে,তাদের বিক্রি করে দেওয়া হয় যৌনব্যবসায়ে কাজে লাগানোর জন্য।এবং এই চক্র সারা বিশ্বব্যাপী এই অপরাধের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। UNESCO র একটি রিপোর্টে বলা হচ্ছে যে সারা বিশ্বে প্রতিদিন ১৭ থেকে৩২ হাজার শিশুকন্যা চুরি হয়ে যায়। সারা বিশ্বের শিশু জনসংখ্যার ৩৭/৩৮ শতাংশ শিশু শ্রমিক হিসাবে কাজ করতে বাধ্য হয়। ইউনেস্কো অত্যন্ত জোরের সাথে প্রতিটি দেশের কাছে আবেদন রেখেছে যে অবিলম্বেএইসব শিশু জীবনের পরিপন্থী জঘন্য অপরাধ মুলক কাজগুলি কঠোর হাতে বন্ধ করা হোক। শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসাবে গণ্য করা হোক।
শিশুর সুশিক্ষা, সুস্বাস্থ্য, ভরপেট খাদ্য, বাসস্থান ইত্যাদির প্রশ্নে আজ প্রতিটি দেশেই বিরাট মাপের নানা কর্মকাণ্ড চলছে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে সারা বিশ্বের প্রতিটি দেশেই বছরের বিভিন্ন সময়ে নির্দিষ্ট কোনো একটি দিনকে শিশু দিবস হিসবে পালন করা হয়,শিশুদের জন্য নানান অনুষ্ঠান করা হয়,বিভিন্ন রকমের বছর ভিত্তিক প্রোগ্রাম নেওয়া হয়। কোন কোন মাসে কোন কোন দেশে শিশু দিবস পালিত হয়, তার তালিকা এইরকমঃ-
জানুয়ারি: থাইল্যান্ড, বাহামা,তিউনিশিয়া।
ফেব্রুয়ারি: কুক এবং কেইম্যান আইল্যান্ডে।
মার্চ: নিউজিল্যান্ড, বাংলাদেশ।
এপ্রিল: হংকং,ফিলিস্তিন, হাইতি,বলিভিয়া, কলম্বিয়া, তুরস্ক, জাম্বিয়া, মেক্সিকো।
মে: জাপান, দঃকোরিয়া,স্পেন,মালদ্বীপ, নরওয়ে, নাইজেরিয়া, হাঙ্গেরি, সামোয়া-কুক আইল্যান্ড, ফকল্যান্ড, সলোমন আইল্যান্ড।
জুন: আলবেনিয়া, এঙ্গোলা,চিন, কম্বোডিয়া, আর্মেনিয়া, চেক প্রজাতন্ত্র,আজারবাইজান, বেলারুশ, বুলগেরিয়া, বসনিয়া, ইকুয়েডর, ইথিওপিয়া,জর্জিয়া,কাজাকাস্তান,লাটভিয়া,লিথুনিয়া,মাকাও,ম্যাসিডোনিয়া,মলদোভা, পর্তুগাল,মঙ্গোলিয়া, মোজাম্বিক, মায়ানমার,পোল্যান্ড, নিকারাগুয়া,তাজিকিস্তান, উজবেকিস্তান,ভিয়েতনাম, ইয়েমেন, ইউক্রেন, সার্বিয়া,শ্লোভাকিয়া, উত্তর কোরিয়া, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র।
জুলাই: পাকিস্তান, পানামা, কিউবা, ভেনেজুয়েলা,ইন্দোনেশিয়া।
আগস্ট: উরুগুয়ে,আর্জেন্টিনা,গুয়াতেমালা, পেরু,প্যারাগুয়ে,ইটালি।
সেপ্টেম্বর: কোস্টারিকা, নেপাল,জার্মানি।
অক্টোবর: চিলি,ইরান, সিঙ্গাপুর, ব্রাজিল, অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়া।
নভেম্বর: ভারত (ইন্ডিয়া), দক্ষিণ আফ্রিকা,ফ্রান্স,ক্রোয়েশিয়া, মিশর, ইউনাইটেড আরব এমিরেটস।
ডিসেম্বর: ক্যামেরুন, ডোমিনিকা, কঙ্গো, সুদান,ওয়েস্ট ইন্ডিজ,সুরিনাম,ইসরায়েল, প্যালেস্টাইন, জর্ডান।
আমাদের দেশে নভেম্বর মাসের ১৪ তারিখে দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পন্ডিত জওহরলাল নেহেরুর জন্মদিনের দিনটি শিশু দিবস হিসাবে পালিত হয়।
শিশুদের সব ক্ষেত্রে সুরক্ষার জন্য দেশের সরকার যেমন দায়বদ্ধ, ঠিক তেমনই আমাদের সমাজের সকলের দায়বদ্ধতাও কম নয়।সেই দিকটি অত্যন্ত সঠিকভাবে দেখতে হবে সমাজের সকল স্তরের মানুষকে। তবেই শিশুদের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত হবে।
কিন্তু আজকের এই মোবাইল,ফেসবুক,ইন্টারনেট সর্বস্ব যুগে,এবং এই ব্যস্ততার সময়ে প্রায় প্রতিটি পরিবারে শিশুরা বড়ো একা হয়ে যাচ্ছে।তাদের হাতে উঠছে অপরিণত বয়সে একটি মোবাইল ফোন। শিশু ডুবে যাচ্ছে মোবাইল ফোনে।আজ পরিবারগুলো সব অতি ছোট পরিবার।সেখানে একটি সন্তান। দুটি সন্তান খুব কম পরিবারে। শিশুদের জীবনে নেই ঠাকুমা,দিদিমা,দাদু,কাকা,পিসি,জ্যাঠা,জেঠিরা,নেই তুতো ভাই বোনেদের ভিড়।তাই হারিয়ে যাচ্ছে শিশুমনের যাবতীয় চাহিদার রসদগুলি।হারিয়ে যাচ্ছে বিকেল বেলার খেলার মাঠের হাতছানি,হারিয়ে যাচ্ছে সমবয়সীদের দলবেঁধে নানান দুষ্টুমি, দৌরাত্ম্য, সমবেত কর্মকাণ্ডগুলি।
ফলে শিশুরা মনের দিক থেকে একা হয়ে যাচ্ছে,অবসাদজনিত নানা রকম সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে।ধৈর্য্য, স্থৈর্য, সুকুমার প্রবৃত্তিগুলি ধীরে ধীরে চুপিচুপি হারিয়ে যাচ্ছে শিশুদের জীবন থেকে। এটা কিন্তু কখনোই কাম্য নয়,সমাজের পক্ষে ভালোও নয়। আজকের শিশুদের জীবন নানান কমপিটিশনে ভরা,বোধহয় সেটাই এযুগের দাবি, চাহিদা।কিন্তু তাতে করে শিশুদের শৈশবের নিজস্বতার দাবীগুলি হারিয়ে যাচ্ছে।
আবার অপরদিকে আমাদের দেশের শহর মফস্বল এবং গ্রামাঞ্চলের একটি বিরাট অংশের শিশুরা তাদের যথাযথ প্রয়োজন মেটাতে পারে না। বাস্তবতার কাঠিন্যে তাদের শৈশব হারিয়ে যায় মাঝপথে,তারা হয়ে যায় স্কুলছুট,পেটের দায়ে শিশু শ্রমিক, কিম্বা তাদের দিয়ে নানান অসামাজিক কাজকর্ম করানো হয় বিরাট চক্রের মাধ্যমে। এইগুলি অত্যন্ত কঠোরভাবে বন্ধ করা দরকার। তবেই আমাদের সমাজে আগামীতে আজকের শিশুদের বলিষ্ঠ মানসিকতার সুস্থ নাগরিক হিসাবে পাবো।তবেই শিশু দিবসের প্রাসঙ্গিকতা বজায় থাকবে।
শিশু দিবসের এই হোক আজকের শপথ।
আজকের ছোট্ট সোনা বন্ধুরা, তোমরা যে যেখানে আছো সক্কলে খুব খুব খুব ভালো থেকো। তোমাদের জন্য আন্তরিক প্রার্থনা রইল,তোমরা বড়ো হও,মানুষ হও, সুস্থ জীবনের অধিকারী হও,সুস্থ মানসিকতায় দেশের দশের মুখ উজ্জ্বল করো।