বাংলা সাহিত্যের অন্যতম একটি বিখ্যাত ছোট গল্প–সমরেশ বসুর ” আদাব”। এই ছোট গল্পে কাহিনির এক চরিত্র নাম মাঝি– সে এক অত্যন্ত গভীর এবং জরুরি প্রশ্ন তুলেছিল —
“আমি জিগাই মারামারি কইরা হইব কী? তোমাগো দু’গা লোক মরব, আমাগো দু’গা মরব। তাতে দ্যাশের কি উপকারটা হইব? কও দিকিনি?”
না উত্তর মেলেনি,সেদিন কেউ উত্তর দিতে পারেননি। উত্তর পাইনি মাঝি–ও। ঠিক তেমনই মারামারি কাটাকাটি, সংঘর্ষ-বিধ্বস্ত অঞ্চলের সাধারণ নাগরিকরাও এর কোনও উত্তর পায়না,কোনওদিনই।
যা পান,বা যা পরিণতি হয় তা হোল,প্রতিদিনের প্রাত্যহিক স্বাভাবিক কাজকর্ম চালিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে এক চরম অনিশ্চয়তা, উৎকন্ঠিত,ভীত-সন্ত্রস্ত মুহূর্তের করুণ অসহায়তার অভিজ্ঞতা।
চারিদিকে একটা ভয়ংকর থমথমে অবস্থা,মানুষের চোখেমুখে ভয়ার্ত দৃষ্টি,একটা আশঙ্কিত মানসিক অস্থিরতা, অবিশ্বাস।
উপদ্রুত অঞ্চলে ভারী বুটের শব্দ তুলে পুলিশ,প্যারা-মিলিটারিদের টহল,বন্ধ ইন্টারনেট, বন্ধ স্বাভাবিক জীবনযাপন ইত্যাদি।
বহু নিরীহ মানুষ ঘরছাড়া হয়,চোখের সামনে মানুষ দেখে দুষ্কৃতিদের বেপরোয়া লুট-পাট করতে। বসতির ঘরে,দোকানে আগুন ধরিয়ে দিতে,বোমাবাজি করতে। প্রাণের ভয়ে,মহিলাদের মান-ইজ্জত লুন্ঠনের ভয়ে,সামান্য সম্বল আঁকড়ে ধরে নিয়ে সাধারণ মানুষ এলাকা ছাড়া হন। অনেকে নিজেদের ভিটেমাটি ছেড়ে এক অনিশ্চিত জীবনের দিকে পা বাড়িয়ে হঠাৎ করে হয়ে যায় উদ্বাস্তু। এই চিত্র এদেশের বুকে বারবার ঘটেছে।সেই তিক্ত, অশ্রুসিক্ত অভিজ্ঞতা রয়েছে আমাদের ইতিহাসে।
মানুষের সভ্যতায় সবচেয়ে বড়ো অভিশাপ হোল সাম্প্রদায়িক হিংসার উন্মত্ততার হিংস্রতা, অমানবিকতা।
জাত-ধর্ম, জাত-পাতের উদগ্র উগ্রতায় মানুষকে আর মানুষ বলে চেনা যায়না।
সাম্প্রদায়িক হিংসা এমনই,যে,তা শুধু মারামারি, খুন-খারাবির রক্তপাতে,ঘরে আগুন লাগানো,নারীর মান-ইজ্জতের মতো জঘন্য,ঘৃণ্য সর্বনাশেই সীমাবদ্ধ থাকেনা।এক বিস্তীর্ণ অঞ্চলের দৈনন্দিন যাপনকে তা একেবারে নষ্ট করে দেয়। রাজনৈতিক দাবা খেলায় লাভের কড়ি ঘরে তোলে রাজনৈতিক স্বার্থপরেরা,মানুষের লাশ নিয়ে টানা-পোড়েন চলে রাজনৈতিক তরজার চাপান উতোরে। সেই দাবার চালে দাবার বোড়ের মত প্রাণ যায় উলুখাগড়াদের মানে আমাদেএ,সাধারণ মানুষের। ক্ষতিপুরনের হিসেব নিকেশ হয়,পারস্পরিক দোষারোপ চালাচালি হয়। কিন্তু চরম ক্ষতি হয় সাধারণ অসহায় নাগরিকদের। আর এইসব অপকর্মের পেছনে থাকে বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী মদতদাতাদের ইন্ধন। তারা ঘোলাজলে চিরকাল মাছ ধরে যায়।
আসুন,আমরা, সাধারণ, অতি সাধারণ শান্তিপ্রিয় নাগরিকবৃন্দ,আমাদের সংকীর্ণ মানসিকতাকে জয় করে, উদারচিত্তে পরস্পর পরস্পরের কাঁধে কাঁধে মিলিয়ে সম্প্রীতির আহ্বান জানাই সকলের কাছে,যে, আমাদের যার যার ধর্ম,ধর্মাচরণের বিশ্বাস আমাদের ব্যক্তিগত পালনীয় যেমন,ঠিক তেমনই পরধর্মের প্রতি আমাদের সহিষ্ণুতা দেখানোও এক ঐতিহাসিক ঐতিহ্য, পরম্পরাগতভাবে অত্যন্ত সংবেদনশীলতায় আমাদের যে কোনও মুল্যে তাকে বজায় রাখতেই হবে। এটাই ইতিহাসের দাবি,এটাই আমাদের সংস্কৃতি।
তাই আসুন,আমরা আমাদের শুভচিন্তায় মনুষ্যত্ব,পরস্পরের প্রতি সৌহার্দ্য জ্ঞাপন করাই হোক এই মুহূর্তের একমাত্র শুভাকাঙ্ক্ষীতার পরিচয়।
সকলের প্রতি বিনম্র আবেদন,সকলে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখুন। কারণ সম্প্রীতি রক্ষা করাই হোল আমাদের সকলের সুস্থভাবে,নিশ্চিন্তে বেঁচে থাকার একমাত্র অঙ্গীকারবদ্ধ্ব আবাহন এবং সার্ব্বজনীন আবেদন।