পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়
চৈত্র-বৈশাখ মাসকে “মধু-মাধব” বলা হয়। কারণ, এই সময়ে প্রকৃতিতে নৈসর্গিকতার এক অনন্য রূপ দেখা যায়। প্রকৃতি ফুলে ফলে সেজে ওঠে, মধু আহরণে মৌ-পিয়াসী হয়ে ওঠে মৌমাছির দল।
বাংলা বছরের শেষ মাস চৈত্র মাস, আর বাংলা বছরের প্রথম মাস হল বৈশাখ মাস। বসন্তের বিদায় স্পর্শ নিয়ে আসে গ্রীষ্ম। এই মধুমাধব মাসের সন্ধিক্ষণেই ভগবান বিষ্ণুর অবতার রূপে নর-নারায়ন,পরশুরাম, নরসিংহ আবির্ভাব হয়েছিলেন।
চৈত্রের সংক্রান্তিতে বাংলার ঘরে ঘরে সন্তান-সহ পরিবারের সকলের শুভকামনায় মায়েরা নীলষষ্ঠী ব্রত পালন করেন। চৈত্রমাস গাজনের মাস,তাই সংক্রান্তির পরের দিন পালিত হয় শিবের গাজন উৎসব, যা চড়ক নামে পরিচিত।
আর তার পরের দিন আসে বৈশাখের পয়লা–আমাদের নববর্ষ। সেদিন বাংলায় পালিত হয় নতুনখাতা,হালখাতা নামে উৎসব বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে। বাংলার ঘরে ঘরে আনন্দ ও খুশী উপচে ওঠে, উছলে ওঠে। এপার ওপার দুই বাংলাতেই,ত্রিপুরায়,
বরাক উপত্যকায়, পয়লা বৈশাখের নাম নববর্ষ। গুজরাটে এর নাম “বেস্তুবর্ষ”, মহারাষ্ট্রে এর নাম “গুড়ি পাদ্ওয়া”, অন্ধ্রপ্রদেশ,
তেলেঙ্গানায় এর নাম–” যুগাদি/ উগাদি”, কেরালায় এর নাম–“ওন্নাম”, আসামে “বোহাগ বিহু”, পাঞ্জাবে নাম ” বৈশাখী”, তামিলনাড়ুতে নাম “পুথুভারুসাম/ পুথান্ডু”, ওড়িশাতে নাম “পানা সংক্রান্তি”, জন্মু-কাশ্মিরে নাম “নভ্রেহ”। সারা বিশ্বে প্রায় সমস্ত দেশেই বাঙালী আছে, তাই,সেখানেও বাংলা নববর্ষের দিনে উৎসব পালিত হয়।
ইতিহাস বলছে, বাংলা নববর্ষ অতি প্রাচীন। আজ থেকে ১৫০০ বছর আগে গৌড় প্রদেশের রাজা ছিলেন শশাঙ্ক। সেই আমল থেকে বাংলা ক্যালেন্ডার এবং নববর্ষ পালিত হয়ে আসছে। তখন ছিল প্রথম মাস অগ্রহায়ণ মাস।পরে ১৫২৬ সালে সম্রাট আকবর বাংলা নববর্ষের দিন পয়লা বৈশাখ থেকে প্রচলন করেন।
পয়লা বৈশাখ মানে সকলের শুভকামনায় প্রার্থনা করা।এ এক পবিত্র দিন। বাঙালির ঘরে বাইরে,মুখরিত হয় আনন্দ এবং শ্রী। পয়লা বৈশাখ মানেই রবীন্দ্রনাথের “এসো হে বৈশাখ এসো এসো..” গানে গানে মুখরিত হয়ে ওঠে প্রভাতফেরী। পয়লা বৈশাখ মানেই হোল কাজী নজরুল ইসলামের ” নমো নমো বাংলাদেশ মম, চির মনোরম, চির মধুর..” গানে গানে পায়ে পায়ে পথ চলার পরিক্রমা। পয়লা বৈশাখ মানেই হালখাতা,নতুনখাতা-র উৎসব –সকলকে আলিঙ্গনে আবদ্ধ করা,মিস্টিমুখ করানো,আন্তরিকতার পরম পরশ পাওয়া। সেখানে নেই কোনও জাতপাতের বৈষম্যতা,নেই ধর্মাধর্মের, উচ্চনীচ-এর কোনও অসহিষ্ণুতার ভেদ-বিভেদের কূপমন্ডুকতা।
তাই পয়লা বৈশাখ, আমাদের পরমাত্মীয়, পরম আদরের,সম্প্রীতির, আন্তরিকতার। সকলের শুভ কামনায়,মঙ্গল কামনায়,নববর্ষ সূচিত হোক বাংলার ঘরে ঘরে, বাঙালির অন্তরে অন্তরে। এই প্রার্থনা রেখে গেলাম।