পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়
অবিভক্ত বাংলার বরিশাল জেলার (এখন বাংলাদেশ) এক অতি সাধারণ পরিবারের সন্তান নগেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়। বাবার নাম ছিল বামনদাস গঙ্গোপাধ্যায় এবং মায়ের নাম নিভাননী দেবী।
এই নগেন্দ্রনাথ পরবর্তী সময়ে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের ছোট মেয়ে মীরাকে বিয়ে করেন। এবং কবির আর নগেন্দ্রনাথের সমন্বয় ইচ্ছাতে আমেরিকাতে কৃষিবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনার জন্য গিয়েছিলেন।ফিরে এসে শিলাইদহের জমিদারি এবং তারপরে জোড়াসাঁকোর বাড়ির তত্ত্বাবধানের কাজ সামলেছিলেন। পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি বিজ্ঞান বিভাগের দায়িত্বও সামলেছেন। তিনি এইসব কাজে তিনি সব ক্ষেত্রেই নিজের দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিলেন। এই ব্যাপারে জানা যায় নগেন্দ্রনাথ এবং শ্বশুর মশাই রবীন্দ্রনাথের চিঠিপত্রের মাধ্যমে। বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসুর লেখাতেও তার প্রামাণ্যতা পাওয়া যায়।
অত্যন্ত বলিষ্ঠ মানসিকতার মানুষ ছিলেন নগেন্দ্রনাথ। এই মানুষটির কাছে প্রজন্মের পর প্রজন্মের বাঙালির শৈশব, কৈশোর চিরকাল ঋণী হয়ে থাকবে। তার কারণ হল বাঙালী জীবনের শৈশব কৈশোর এর মনের ক্ষুধার,চাহিদার মননশীল মানসিকতার কথা প্রথম চিন্তা করেছিলেন এই মানুষটি।
আজ থেকে ১০৩ বছর আগে ১৩২৫ বঙ্গাব্দ… নগেন্দ্রনাথ বাংলাদেশের (অবিভক্ত) বালক বালিকাদের উপযোগী একটি শারদীয় সঙ্কলন গ্রন্থ প্রকাশের পরিকল্পনা করেন।
তেমন মুলধন ছিল না। অগত্যা শ্বশুর মশায়ের দ্বারস্থ হওয়া। কিন্তু শ্বশুর মশাই রবীন্দ্রনাথের আর্থিক অবস্থা তখন খুবই খারাপ। নগেন্দ্রনাথ পড়লেন মহা বিপদে।
এ দিকে বইয়ের নাম দিয়ে দিয়েছেন…”পার্ব্বণী”। পাতার সংখ্যা হবে ১৭০/১৮০। রবীন্দ্রনাথ প্রবাসীর সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের কাছ থেকে জানলেন যে,প্রায় ৬০০ টাক খরচ পড়বে। এত খরচ?মাথায় হাত।এদিকে লেখা দিয়ে দিয়েছেন স্বয়ং নগেন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথ, অবনীন্দ্রনাথ, রথীন্দ্রনাথ, সুধীন্দ্রনাথ, সুকুমার রায়,শরৎচন্দ্র, জগদানন্দ রায়,সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, শিবনাথ শাস্ত্রী, সীতা দেবী, প্রিয়ম্বদা দেবী, ইন্দিরা দেবী, সরলা দেবী, গগনেন্দ্রনাথ, নন্দলাল বসু, সুরেন্দ্রনাথ কর, প্রমুখ, প্রমুখ।
যাইহোক, ১৩২৫ বঙ্গাব্দের আশ্বিনের প্রথম দিনে অনেক বাধা টপকিয়ে বাংলা সাহিত্যে ছোটদের শারদীয়া সঙ্কলন গ্রন্থ “পার্ব্বণী” প্রকাশ হয়েছিল। সাদা কালো, রঙিন ছবিতে বইটি সাজানো ছিল। নগেন্দ্রনাথ এই বইটি বাংলার সকল শিশু কিশোর কিশোরীদের উৎসর্গ করেছিলেন। ১৭২ পাতার এই বইয়ের দাম ছিল মাত্র দেড় টাকা। রবীন্দ্রনাথ বইটি পড়ে আপ্লূত হয়ে লিখেছিলেনঃ “তোমার ‘পার্ব্বণী’ পড়িয়া বিশেষ আনন্দ পাইয়াছি। ইহা ছেলে বুড়ো সকলেরই ভালো লাগিবে।ইহা আমাদের শিশু সাহিত্যের ভাণ্ডারে নিত্য ব্যবহারের জন্যই রাখা হইবে…।তুমি আজ ইতিহাস রচিলে…”।
কিন্তু হায়,আমরা…বাঙালিরা নগেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়কে মনেই রাখিনি। তাই,হয়তো অভিমান নিয়েই তিনি এদেশ ছেড়ে চলে যান বিদেশে। লন্ডনে ১৯৫৪ সালের ১ ফেব্রুয়ারি তিনি মারা যান।
আজ থেকে ১০০ বছর আগে বাঙালির ছোটদের শারদীয়া সাহিত্য গ্রন্থের প্রকাশ। যে মানুষটির উদ্যোগে এই কাজ সেদিন হয়েছিল, তাঁকে আমাদের অসংখ্য প্রণাম।