প্রথম পাতা প্রবন্ধ কাজী নজরুল ইসলাম এবং এক অনন্য অন্য দৃষ্টিকোণ

কাজী নজরুল ইসলাম এবং এক অনন্য অন্য দৃষ্টিকোণ

414 views
A+A-
Reset

পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়

খুব বাস্তব সত্যকথা এটাই,যে আজও কাজী নজরুল ইসলাম-এর যথার্থ মূল্যায়ন আমরা বাঙালীরা এবং আমাদের ভারতবর্ষ আর বাংলাদেশের রাষ্ট্রিয় পর্যায়ে করতে পারিনি এবং হয়নি।

একটা কথা ভাবলে খুব আশ্চর্য লাগে যে আমরা এই মহাদেশের এই ভূ-খন্ডের মানুষরা কাজী নজরুলকে শুধুমাত্র বিদ্রোহী কবি আর নজরুলগীতিতে বন্দী করে রাখলাম।একবারও মূল্যায়ন করলাম না নজরুলের মাত্র ২২ বছরের সৃষ্টিশীলতা নিয়ে।
একথা অনস্বীকার্য যে সারা বিশ্বে একমাত্র কাজী নজরুল ইসলাম সমস্ত সাম্প্রদায়িকতার উর্ধ্বে উঠে,এবং তাঁর মাতৃভাষা বাংলার সাথে উর্দু এবং আরবি ভাষা সঠিকভাবে মিশিয়ে কাব্য এবং সঙ্গীত রচনা করেছেন। রচনা করেছেন সেই সময়কার আমাদের অখণ্ড ভারতবর্ষের জাতীয়তাবাদ আন্দোলনের প্রেক্ষিতে,হিন্দু মুসলিম সম্প্রদায়ের চিরকাল বহমান ভক্তিরসের প্রেক্ষিতে,সাম্যবাদের প্রেক্ষিতে,খেটেখাওয়া সমাজের নীচুতলার মানুষের ওপরে অন্যায় অবিচারের প্রতিবাদের প্রেক্ষিতে,সমাজের যত অনিয়মের বিরুদ্ধে,আবার মানবিক স্নেহ ভালোবাসার প্রেক্ষিতে অসংখ্য সঙ্গীত ও কবিতা।যা বিশ্বসাহিত্যে বিরলতম ঘটনা।

সম্প্রতি নজরুলের –“কারার ঐ লৌহকপাট ভেঙে ফেল্ কর্ রে লোপাট,রক্ত জমাট শিকলপুজার পাষানবেদি..”
গানটিকে যথাযোগ্য সম্মান না দিয়ে ভারত তথা বিশ্বখ্যাত সঙ্গীতকারের কাজের বাংলা সহ দেশব্যাপী (প্রতিবেশী বাংলাদেশ সহ)সমালোচনার ঝড় বয়ে গেছে। কারন এই গানটি এই দেশের স্বাধীনতার আন্দোলনের এক ঐতিহাসিক ঐতিহ্যময় জাতীয়তাবাদী গান।যা সেই সময়ের স্বাধীনতা যোদ্ধাদের মুখে মুখে ফিরতো।বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়েও এই গান ছিল বিপ্লবী তথা মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাণের শপথ।আজও এই গান এক উদ্দীপনার গান। ১৯২১ সালে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছিল সাপ্তাহিক পত্রিকা– “বাঙ্গলার কথা”। সেই সময় স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রবল জোয়ার চলছিল বাঙ্গলা জুড়ে, সারা দেশ জুড়ে। আন্দোলনকে দমন করার জন্যে তদানীন্তন শাসক, ব্রিটিশ সরকার আর তার পুলিশ এখনে ওখানে বহু তরুণ দেশপ্রেমিকদের গ্রেফতার করেছিল। অমানবিক অকথ্য অত্যাচার চালিয়েছিলো। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস গ্রেফতার হলেন,তারপর, দেশবন্ধুর স্ত্রী বাসন্তী দেবী পত্রিকা পরিচালনার ভার নিয়েছিলেন। সেই সময়েই বাসন্তী দেবী “বাঙ্গলার কথা” পত্রিকাতে ছাপানোর জন্য একটি কবিতা পাঠানোর জন্য নজরুলের কাছে পাঠান সুকুমার রঞ্জন দাস-কে। কাজী নজরুল সঙ্গে সঙ্গে একটি কবিতা-গান লিখে দেন। এবং,সেই কবিতা-গানটি “ভাঙার গান” শিরোনামে “বাঙ্গলার কথা” পত্রিকাতে প্রকাশিত হয়েছিল ২০ শে জানুয়ারী, ১৯২২ সালে। তখন হুগলিতে কারাবন্দী দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস এবং অন্যান্য বন্দীরা এই গানটি গাইতেন ব’লেও কথিত আছে। সেই গানের সাথে খুব স্বাভাবিকভাবেই আজ ১০০ বছর পরেও মানুষের আবেগ জড়িয়ে আছে এক ঐতিহাসিক সূত্রে। গানটি বাঙলার মানুষের ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শাসন ব্যবস্থার শোষনের বিরুদ্ধে এদেশের গণমুক্তির আকাঙ্খা এবং সংগ্রামী চেতনার ঐতিহাসিক প্রতিবাদের ঐতিহ্যবাহী। ফলে গানটির মুল সুরের বিকৃতি কোনমতেই গ্রহনযোগ্য নয়।ফলে সেই কাজ এপার ওপার দুই বাঙ্গলার মানুষের সংগ্রামী ইতিহাসকে এবং বাঙালির আবেগকে আঘাত করেছে।আর তাই, সঙ্গত কারনেই প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছে শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ।

এবার আলোচনায় আসবো একটি অন্য আঙ্গিকে। কাজী নজরুল ইসলামের গানের সংখ্যা প্রায় ৩ হাজার। খুব স্বাভাবিকভাবেই সব গানগুলিই সমান পরিচিত নয় আমাদের কাছে। নজরুলগীতি বললেই আমাদের স্মরণে আসে তাঁর দেশাত্মবোধক গান,প্রেম-বিরহের গান, এবং ভক্তিগীতি। তিনি হিন্দু সম্প্রদায়ের শাক্তমতের প্রেক্ষিতে গান লিখেছেন,গান লিখেছেন বৈষ্ণবমতের প্রেক্ষিতেও।যেমন,উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়–“কালো মেয়ের পায়ের তলায় দেখে যা আজ আলোর নাচন..”,আবার “হে গোবিন্দ রাখো হে চরণে..”,প্রভৃতি। আবার ইসলামি সঙ্গীতও তিনি রচনা করেছেন।বলা যেতে পারে নজরুলের একদেহে লীন হয়ে হয়ে গেছে হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষের অন্তরে অন্তরে পরম্পরাগত যে আবেগ রয়ে গেছে,সেই আবেগের ভালোবাসা আর শ্রদ্ধাখানি।

ইসলামি সঙ্গীতে সাধারণত থাকে দুটো দিক,একটি “হামদ্”,মানে সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ্-র প্রশস্তিগীত সূচক গান,আর আরেকটি হলো “নাত্”–মানে,পয়গম্বর নবী মুহম্মদের গুণকীর্তন করা হয় যে গানে। সঙ্গীতের মাধ্যমে নজরুল তুলে ধরেছেন একদিকে যেমন ইসলামের ইতিহাস,ঐতিহ্য,সংস্কৃতি এবং পবিত্র কোরান-হাদিশের প্রসঙ্গ,ঠিক তেমন-ই হিন্দু সম্প্রদায়ের শ্যামা-সঙ্গীত, কৃষ্ণ-গীতিতেও তিনি তুলে ধরেছেন গীতা পুরাণের,চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের ঐতিহ্যকে। ইসলামি গানে আজানের সুরে মগ্ন-মোহিত হয়ে নজরুল লিখছেন–” মসজিদেরই পাশে আমায়,কবর দিও ভাই,// যেন গোরে থেকে মুয়াজ্জিনের আজান শুনতে পাই..”। আবার তিনি লিখছেন –” যেদিন রোজ হাশরে করতে বিচার, তুমি হবে কাজী,//সেদিন তোমার দিদার্ আমি পাব কি আল্লাহ্-জী”।

বাংলায় ভক্তিগীতিতে উজ্জ্বল নক্ষত্র হলেন কাজী নজরুল ইসলাম। হিন্দুধর্মের সঙ্গে যুক্ত সম্প্রদায়ের রামপ্রসাদ, কমলাকান্ত,রজনীকান্ত,অতুলপ্রসাদ, দাশরথি রায়, প্রমুখদের পাশাপাশি কাজী নজরুল ইসলাম শ্যামা-শ্যাম মহিমায় গান লিখেছেন, যা কালজয়ী গান বাঙালির কাছে।আবার ইসলামি সঙ্গীতের উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর গানের প্রাঞ্জলতায়। ১৯৩১ সালে নজরুলের লেখা,–“ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে,এলো খুশীর ঈদ রে..” বাঙালি মুসলিমদের প্রধান পরবের আনন্দীগীতি হয়ে উঠলো। আবার পাশাপাশি, তুরস্কের বিখ্যাত গান “কাটিবিম ইশকাদার..” এর সুরে তিনি লিখলেন,– “ত্রিভুবনের প্রিয় মুহম্মদ, এলো রে দুনিয়ায়..” (এই গানটির সুর নজরুলের “শুকনো পাতার নূপুর পায়ে…”-এর সুরের একই ছন্দে এবং লয়েতে নিবদ্ধ)। তিনি আরও লিখলেন ইসলামি সঙ্গীত, –” আমিনা দুলাল নাচে,হালিমার কোলে..”।কতকটা “দেবকী দুলাল নাচে, যশোদা কোলে রে..”-এর মতো। আবার তিনি লেখেন, ” তোরা দেখে যা আমিনা মায়ের কোলে..”, কিম্বা,”শোনো শোনো, ইয়া ইলাহী,আমার মোনাজাত্..”-।এইসব গানের সুরের আর্তি এবং আবেদন এক পরম পাওয়া শান্তির অনুভব জাগিয়ে তোলে মানুষের অন্তরের শীতলপাটিতে।সেখানে হিন্দু-মুসলিম ভেদ-বিভেদ নেই,নেই হিংসা-বিদ্বেষ। শুধু বিবিধের মাঝে মিলনের মহত্বে একাকার।

নজরুল এইসব গানে বাংলা-আরবি-ফার্সি-উর্দু-হিন্দী শব্দের যথাযথ মিশ্রণ ঘটিয়ে ব্যবহার করেছেন। যেমন,” আল্লাকে যে পাইতে চায় হজরতকে ভালোবেসে,/ আরশ্ কুর্সি লওহ্ কালাম্ না চাহিতেই পেয়েছে সে..”, কিম্বা,” হে নামাজী,আমার ঘরে নামাজ পড়ো আজ,/ দিলাম তোমার চরণতলে হৃদয় জায়্নামাজ্..”।

আবার তিনি স্বপ্ন দেখছেন,লিখছেন সে কথা গানে গানে,–” ওরে ও দরিয়ার মাঝি,মোরে নিয়ে যা রে মদিনায়..”, অথবা, দূর আরবের স্বপন দেখি,বাংলাদেশের কুটির হতে..”, কিম্বা, “মনে বড় আশা ছিল যাব মদিনায়..”। নজরুল কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছেন গানে গানে –” এই সুন্দর ফুল,সুন্দর ফল,মিঠা নদীর পানি,/ খোদা তোমার মেহেরবানী.. “। নজরুল প্রার্থনা করছেন মৃন্ময়ী দেবীর কাছে বিনম্র মনের বড় সাধ নিয়ে..” মাগো চিন্ময়ী রূপ ধরে আয়..”।

বাংলা তথা ভারতবর্ষে একমাত্র নজরুলই আল্লাহ্,কালী,কৃষ্ণ,যীশুর বন্দনায় একাত্ম হয়েছেন তাঁর সৃষ্ট সঙ্গীতের সুর ও বানীতে,যা এই পৃথিবীতে বিরল। আবার এই কাজী নজরুল লিখছেন,এক আন্তর্জাতিক স্তরের গান, — “জাগো অনশন বন্দী ওঠোরে যত,জগতের লাণ্ছিত ভাগ্যহত..”। নজরুল সেই শাশ্বত কথা লিখছেন,–” গাহি সাম্যের গান,/মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই এ জগতে মহীয়ান..”।

কাজী নজরুল ইসলাম, বোধহয় একমাত্র কবি এই বিশ্বে, যিনি তাঁর জীবনের বাস্তব পরিণতির ভবিষ্যৎদ্রষ্টা ছিলেন,তাইতো তিনি আগেই লিখে গিয়েছিলেন–“ফুলের জলসায় নীরব কেন কবি..”(কলকাতার ইন্টালীর কাছে ক্রিস্টোফার রোডের বাড়িতে নজরুলের জন্মদিনে একটি তক্তপোশের ওপরে সাদা ধুতি আর পাঞ্জাবীতে সজ্জিত মহাকবি কাজী নজরুল উদাস নয়নে আত্মমগন নয়নে,চারিদিকে বড় বড় চোখের তারার দৃষ্টিতে কি যেন খুঁজে যান, আর গলায় পরানো সাদা রজনীগন্ধার মালা,বেলফুল,জুঁই ফুলের মালা থেকে ফুলগুলি আপনমনে দুই হাত দিয়ে ছিঁড়ে ছিঁড়ে ফেলে দেন এখানে ওখানে..। নিবিষ্ট দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখলে দেখা যেত এই বাংলার,এই ভারতবর্ষের, এই পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি,গীতিকার, সুরকার কাজী নজরুল ইসলামের চোখে জল। কে জানে কেন তাঁর এই ব্যাথা কেইবা জানে তাঁর সেই কান্নার কারন? এই অভিজ্ঞতা একান্ত এই প্রবন্ধকারের নিজস্ব,১৯৭১ সালের নজরুলের জন্মদিনের দিন।)

আজ আমাদের অস্থির,অসহিষ্ণু জন্মভুমির উপত্যকায় তাঁকে বড় প্রয়োজন,কারন, কাজী নজরুল ইসলাম ভালোবাসার এক অনন্য শিলালিপি। সমানুভূতির অনুভবে এক মানবিক প্রতিজ্ঞার দরদী মহানুভবতার নাম কাজী নজরুল ইসলাম। এক আজান-শঙ্খধ্বনির অত্যন্ত প্রয়োজনীয় সম্মিলিত সহিষ্ণুতার নাম,কাজী নজরুল ইসলাম। মন্দিরে, তুলসীতলায়, মাজ্হারে, মসজিদে, দরগায় সন্ধ্যা প্রদীপের অনির্বান আলোর মতো সৃজনশীল সম্প্রীতি এবং ভালোবাসার নাম, কাজী নজরুল ইসলাম।

আরও খবর

মন্তব্য করুন

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

সম্পাদকের পছন্দ

টাটকা খবর

©2023 newsonly24. All rights reserved.