প্রথম পাতা প্রবন্ধ মণিকর্ণিকা থেকে লক্ষীবাঈ…কিছু অজানা কথা

মণিকর্ণিকা থেকে লক্ষীবাঈ…কিছু অজানা কথা

369 views
A+A-
Reset

পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়

বারাণসীতে পুতপবিত্র গঙ্গার এক বিখ্যাত ঘাটের নাম মনিকর্ণিকা ঘাট। তারই অদুরে এক মারাঠী ব্রাহ্মণ পরিবার বাস করতেন।সেই পরিবারে ১৮২৮ সালের ১৯ শে নভেম্বর জন্মগ্রহণ করেন এক ঐতিহাসিক প্রতিবাদী চরিত্রের শিশুকন্যা। বাবা মারোপন্ত তাম্বে খুব আদর করে মেয়ের নাম রাখলেন মণিকর্ণিকা। মা ভাগীরথী বাঈ সেই নাম একটু ছোট করে নিয়ে আদরের মেয়েকে ডাকতেন “মনুয়া” বা “মনু” বলে।

খুব দুষ্টু ছিল সেই মেয়েটি। সারাদিন ছিল তার দস্যিপনা। মা সামাল দিতেন মেয়েকে।বেশ সুখে আনন্দেই চলছিল দিনগুলি। কিন্তু,হঠাৎ করেই নেমে এলো এক দুর্ঘটনার কালো ছায়া। মনু-র যখন চার বছর বয়স,তখন তার মা মারা গেলেন। অগত্যা বাবা মেয়েকে নিয়ে চলে এলেন বিথুরে,সেখানেই পিসিদের কাছে বড়ো হতে লাগলো মনুয়া। বাবা ছিলেন দ্বিতীয় পেশোয়া বাজীরাও-য়ের অধীনে উচ্চপদস্থ এক কর্মচারী।বাবার সাথে মাঝেমধ্যে মেয়ে যেত পেশোয়া-র কাছে।পেশোয়া বাজিরাও নিজের পুত্র নানা ফড়নবিশ-কে( পরে সিপাহি বিদ্রোহের অন্যতম নায়ক নানা সাহেব) যে স্নেহের চোখে দেখতেন,সেই স্নেহের চোখেই মনুয়াকেও দেখতেন।

ছোটবেলা থেকেই মনু ঘোড়ায় চড়া,অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহার সহ যুদ্ধ করার রীতিনীতি সবেতেই খুব পারদর্শী হয়ে ওঠে।প্রচন্ড স্বাধীনচেতা ছিলেন এই মনু তথা মনুয়া তথা মণিকর্ণিকা তাম্বে। ১৮৪২/৪৩ সালে ১৪/১৫ বছর বয়সে মনুর বিয়ে হয়েছিল ঝাঁসীর মহারাজা গঙ্গাধর রাও নিয়রকারের সঙ্গে। বিয়ের পরে মণিকর্ণিকা নাম পালটে তার নতুন নামকরণ হয়–“লক্ষীবাঈ”। ১৮৫১ সালে তিনি একটি পুত্রসন্তানের জন্ম দেন।খুব আনন্দের সাথে নাম রাখা হয় দামোদর রাও। কিন্তু, মাত্র চার মাসের শিশু দামোদর অকালে মারা যায়। শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়েন গঙ্গাধর রাও এবং লক্ষীবাঈ। তখন গঙ্গাধর রাও তাঁর জ্যাঠামশাই-এর ৫ বছরের নাতি আনন্দ রাও-কে দত্তক নিয়ে নতুন নামকরণ করা হয়,–“দামোদর রাও”।

দুর্ভাগ্যের ব্যাপার এই অনুষ্ঠান হয়েছিল ১৮৫৩ সালের ২০ শে নভেম্বর আর পরেরদিন ২১শে নভেম্বর ভোরবেলায় গঙ্গাধর রাও মারা যান। তখন লক্ষীবাঈ-এর বয়স মাত্র ২৫ বছর। তিনি এবার রাজ্যের হাল ধরলেন।মন দিলেন নারী রক্ষীবাহিনী গড়ার কাজে।গড়ে উঠলো এক বিশাল নারীবাহিনী।তারা ঘোড়ায় চড়া,তরোয়াল চালনা সহ যুদ্ধের নানা রকমের কসরত শিখতে লাগলেন।নেতৃত্ব দিতেন ঝাঁসীর রানী মণিকর্ণিকা লক্ষীবাঈ।

তখন ভারতের শাসক ব্রিটিশ সরকারের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। সেই সময় ভারতের গভর্নর জেনারেল লর্ড ডালহৌসি। এই ডালহৌসি ভারতবর্ষের বিভিন্ন ছোট বড় মাঝারি এদেশীয় রাজ্যগুলিকে নিজেদের দখলে রাখার জন্য একটা আইন করেছিল যে যদি কোন রাজ্যের রাজা মারা যান অপুত্রক অবস্থায়,তাহলে তার সেই রাজ্য নিজেদের দখলে নিয়ে নেবে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। সেই মোতাবেক ছলে বলে কৌশলে অনেক রাজ্যকে তারা কেড়েও নিয়েছিল।এবার নজর পড়ে ঝাঁসীর ওপরে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রতিনিধি মিস্টার এলিস প্রস্তাব দিলেন যে ব্রিটিশ ঝাঁসী রাজ্য নিয়ে নেবে,প্রজারা সমস্ত কর দেবে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে, বিনিময়ে ঝাঁসী রানীকে ব্রিটিশ দেবে বছরে ৬০ হাজার টাকা ভাতা।আর রানীকে ঝাঁসীর কেল্লা,দুর্গ ছেড়ে চলে যেতে হবে। রানীর স্বাধীনচেতা চরিত্রে অপমান মনে হলো,তাঁর আত্মসম্মানে লাগলো।

শুরু হল বিরোধ।ইতিমধ্যে ১৮৫৭ সালে শুরু হোল সিপাহি বিদ্রোহের বিক্ষোভ সারা ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে। সিপাহী বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিতে লাগলেন ঝাঁসীর রানী মণিকর্ণিকা লক্ষীবাঈ, নানা ফড়নবিস (নানা সাহেব),তাঁতিয়া তোপি,মঙ্গল পাণ্ডে,বেগম হজরত মহল,প্রমুখরা।ব্রিটিশ ঝাঁপিয়ে পড়লো সেই সকল বিদ্রোহকে দমন করতে।

প্রচণ্ড যুদ্ধ শুরু হল ১৮৫৮ সালের গোড়ায়। চারিদিকে ভারতের বীর সন্তানরা যুদ্ধক্ষেত্রে শহীদ হয়েছিলেন।ঝাঁসীরানী লক্ষীবাঈ দত্তক সন্তান শিশুকে কাপড় দিয়ে নিজের পিঠেতে বেঁধে নিয়ে ঘোড়ায় চড়ে ডান হাতে খোলা তরোয়াল নিয়ে ব্রিটিশ সেনাদের সঙ্গে লড়াই করতে করতে যুদ্ধক্ষেত্রেই ১৮৫৮ সালের ১৭ই জুন শহীদ হন।

এখানে উল্লেখ্য নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু আজাদ হিন্দ বাহিনীর নারী ব্রিগ্রেডের অর্থাৎ নারী বাহিনীর নাম দিয়েছিলেন “ঝাঁসীরানী বাহিনী”, যার নেতৃত্বে ছিলেন আর এক লক্ষী…ডাক্তার লক্ষী স্বামীনাথন, তথা লক্ষী সায়গল।

আমাদের দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের নাম ঝাঁসীর রানী মণিকর্ণিকা লক্ষীবাঈ। তাঁর শহিদ স্মৃতিতে রেখে গেলাম প্রণাম।

আরও খবর

মন্তব্য করুন

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

সম্পাদকের পছন্দ

টাটকা খবর

©2023 newsonly24. All rights reserved.