প্রথম পাতা প্রবন্ধ উপেক্ষিত এক বিজ্ঞানী শম্ভুনাথ দে

উপেক্ষিত এক বিজ্ঞানী শম্ভুনাথ দে

66 views
A+A-
Reset

পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়

বাঙালী আত্মবিস্মৃত,কর্তাভজা জাত।তার রক্তের শিরায় শিরায় কলোনিয়াল হ্যাংওভার। বিদেশীদের, সাহেব-সুবো-দের শিরোপা যতক্ষন কেউ না পায়–ততক্ষন আমরা বাঙালীরা তাকে ঠিকঠাক পাত্তাই দিই না। এটা আমাদের ঐতিহ্য এবং পরম্পরা।

এই কথাগুলি কতটা সত্য,তা এই গল্প হলেও সত্যি কাহিনি শুনলে,বা পড়লেই বুঝতে পারবেন।

এই বাংলারই মফঃস্বলের মানুষ এবং পড়াশোনা এবং পরে কাজের সুত্রে এই কলকাতার বুকেই ছিলেন সুদীর্ঘ কাল,কিন্তু, না– আমরা বাঙালীরা প্রায় ৯৯ শতাংশ মানুষই তাঁকে জানিনা,চিনিও না।নামটাই বলতে পারব না।

তিনি হলেন অনুজীব-বিজ্ঞানী (Microbiologyst) শম্ভুনাথ দে। ৯৯ শতাংশ মানুষ জানেনই না তাঁর কি আবিষ্কার? কেন তিনি সারা বিশ্বে সমাদরে সমাদৃত।

যাইহোক,১৯১৫ সালে ১ লা ফেব্রুয়ারী হুগলী জেলার গরিবাটি গ্রামে এক দরিদ্র পরিবারে তাঁর জন্ম হয়েছিল। অভাবের সংসার, তারই মধ্যে অনেক কষ্ট করে পড়াশোনা করে ১৯৩৯ সালে কলকাতার মেডিকেল কলেজে ডাক্তারী পড়া শুরু করেন শম্ভুনাথ। সেখান থেকে M.B. পাশ করে কলকাতার ট্রপিক্যাল অফ মেডিসিনে ভর্তি হন শম্ভুনাথ,১৯৪২ সালে। এরপর তিনি লন্ডনে চলে যান।সেখানে তিনি ১৯৪৭ সালে University of College And Hospital Medical School থেকে Morbid Anatomy বিভাগে ডাক্তার রয় ক্যামেরনের তত্ত্বাবধানে তিনি P.HD. করেন। হাইড্রোসেফালাস, মানে মানুষের মস্তিষ্কে CSF( Cerebro- Spinal fluid//বা মস্তিষ্ক-সুষুম্না কান্ডের রস) জমা হওয়ার বিভিন্ন reaction,Influence, causes,etc..গুলি খুঁজে বের করাই ছিল তাঁর গবেষণার বিষয়।

এখানে উল্লেখ্য, যে,সারা পৃথিবীতে অষ্টাদশ, শতাব্দীতে, উনবিংশ শতাব্দীতে কলেরা,বা ওলাউঠা রোগ ছিল এক বিভৎস মহামারী। আমাদের দেশে,আমাদের এই বাংলাতেও এই রোগ ছিল এক মারাত্মক মারণ-ব্যাধি। রোগ -টি জলবাহিত রোগ। কিন্তু তখন কেউই এই রোগের বিষয় কিচ্ছুই জানতো না।তার উৎস, তার কারন,তার প্রতিকার,ইত্যাদি ব্যাপারে মানুষ ছিল সম্পূর্ণ অন্ধকারে। কারন এই রোগের ওপরে কোনও গবেষণাই তখনো শুরুই হয়নি। এদিকে এই বাংলায়,সারা বিশ্বে বিভিন্ন দেশে দেশে গ্রামের পর গ্রাম, শহর,শহরতলী উজাড় হয়ে যাচ্ছে কলেরার প্রকোপে। লক্ষ লক্ষ মানুষ অকালে প্রাণ হারাচ্ছে।

১৮৮৪ সালে Microbiologyst (অনুজীববিজ্ঞানী) Dr.Robert Koch( রবার্ট কখ্) প্রথমে লন্ডনে,পরে কলকাতায় এসে গবেষণা শুরু করেন,এবং দীর্ঘ গবেষণা শেষে তিনি কলেরা রোগ সৃষ্টিকারী জীবানু “vibrio cholerea” আবিষ্কার করেন। সেই গবেষণার তথ্যগুলি “koch’s Postulates” নামে পরিচিত। তারপর কিন্তু আর এগোইনি সেই গবেষণা। কখ্ মারা যান। দীর্ঘ ৭৫ বছর পরে ১৯৫৯ সালে আমাদের বাংলার সেই শম্ভুনাথ দে বিজ্ঞানী রবার্ট কখ্-এর অসমাপ্ত কাজ নিয়ে কাজ শুরু করেন,এবং,অবশেষে কলেরার টক্সিন আবিষ্কার করেন,আর বিজ্ঞানী রবার্ট কখ-এর অসমাপ্ত কাজ পূর্ণ করেন শম্ভুনাথ দে।

এই শম্ভুনাথ দে ঐ সময়েই কলেরা রোগীর শরীরে dehydration এর সুরাহার জন্যে তৈরী করেন Oral rehydration therapy (ORT)।যাতে বাইরে থেকে বিশুদ্ধ জল (Hydro),
electrolyte (লবন), Glucose(চিনি)-র মিশ্রণ। যা তৈরী করার জন্য সহজ,সুলভ,এবং খরচ অল্প। সারাবিশ্বে এই ও.আর. টি. কলেরার মৃত্যুর হার ৫০ শতাংশ থেকে নামিয়ে আনে ৩.৬ শতাংশতে। এই ORS কে ১৯৮০ সালে World Health Organisations (বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা) মান্যতার স্বীকৃতি দেয়।

বিজ্ঞানী শম্ভুনাথ দের নাম বিশ্বের মানুষের কাছে সমাদৃত হতে থাকে।সারা বিশ্বের বহু পুরষ্কারে তিনি ভুষিত হন,এবং নোবেল পুরষ্কারের জন্যও তাঁর নাম বহুবার আলোচিত হয়।কিন্তু অদৃশ্য কোনও কারনে তিনি নোবেল পুরষ্কারে ভূষিত হন নি।
এই নিয়ে কোনও অভিমান ছিল না তাঁর।

১৯৮৫ সালে ১৫ই এপ্রিল তিনি আমাদের ছেড়ে চলে যান।
আমাদের দেশে তিনি যথাযথ সম্মান পাননি। তিনি বুকভরা সেই অভিমান নিয়ে চলে যান জীবন মরনের সীমানা ছাড়িয়ে..।

হায়রে বাঙালী—হায়রে ভারতবর্ষ —
উপেক্ষাতেই বুঝি তোমার পরম আনন্দ?

ভালো থাকুন বিজ্ঞানী শম্ভুনাথ দে,– আপনি ভালো থাকুন। অনেক কৃতজ্ঞতা রেখে গেলাম।মানব সভ্যতাকে এক মহামারীর হাত থেকে বাঁচানোর জন্য।এই ঋণ মানবজাতি বিনম্র চিত্তে স্মরণ করে।স্মরণ করে বিজ্ঞানী শম্ভুনাথ দে–কে।

মন্তব্য করুন

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

সম্পাদকের পছন্দ

টাটকা খবর

©2023 newsonly24. All rights reserved.