পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়
সিন্ধুসভ্যতার ইতিহাসে দেবাদিদেব মহাদেব-এর আরাধনার নিদর্শন পাওয়া যায়। পরবর্তীতে বৈদিক যুগে,এবং তারপর শুঙ্গ,কুষান,গুপ্ত,মৌর্য যুগে, পুষ্য বংশের রাজত্বকালেও এই মহাদেবের পুজোর ইতিহাস পাওয়া যায়। এমনকি পাল বংশের রাজত্বকালে, সেন বংশের রাজত্বকালেও শিবের পুজার নিদর্শন মেলে। প্রত্নতাত্ত্বিক ঐতিহাসিকরা বলেন যে দেবাদিদেব মহাদেব ছিলেন আদিযুগে অবিভক্ত ভারতবর্ষের বিশাল ভুখন্ডের আরাধ্য দেবতা। আবার কেউ কেউ বলেন শিব হলেন অনার্যদের আরাধ্যদেবতা, পরে বাইরে থেকে আর্যরা এই ভুখন্ডে এসে বসবাসের সময়ে অনার্য এবং আর্য একসাথে মিলেমিশে যাওয়ার ফলে এক নতুন সংস্কৃতিতে শিবের পুজা ভারতের সামাজিক সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসাবে সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
সেই পরম্পরা থেকে আমরা জানতে পারি,যে শুধু ভারতবর্ষে নয়,শিবের আরাধনা সুদুর নেপাল,ভুটান,তিব্বত,ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, কম্বোডিয়া,থাইল্যান্ড, মায়ানমার, রেঙ্গুন, শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ,পাকিস্তান, আফগানিস্তান, বেলুচিস্তান, তাইওয়ান, প্রভৃতি দেশেও শিবের আরাধনা হয়। আর শিবকে আরাধনার এক অঙ্গ হিসাবেই ফাল্গুন মাসে শিব চতুর্দশীর দিনে শিবরাত্রি ব্রত পালন করা হয়। আর এই ব্রত হলো সমাজের নারীদের এক ঐতিহাসিক ঐতিহ্যের পরম্পরা। এদিন মহিলারা উপবাস করেন এবং শিবের পুজা করেন সকলের মঙ্গল কামনায়।
সারা ভারতবর্ষে, নেপালে, ভুটানে, শ্রীলঙ্কায়, বাংলাদেশে, পাকিস্তানে, ইন্দোনেশিয়ায়, মালয়েশিয়ায়, মায়ানমারে, রেঙ্গুনে, তাইওয়ানে, থাইল্যান্ডে, তিব্বতে, আফগানিস্তানে, বেলুচিস্তানে, ইত্যাদি স্থানে শিবের মন্দির আজও আছে। সেখানে সারাবছর শিবের পুজা যদিও হয়,কিন্তু শিবরাত্রির এই বিশেষ দিনে সেখানে সেখানকার সমাজের নারী পুরুষ সকলে একত্রিত হয়ে শিবের পুজো করেন এবং শিবরাত্রি ব্রত উদযাপন করেন। তবে এই ব্রত উদযাপনে সমাজের নারীদের ভুমিকাই উল্লেখযোগ্য।
আমরা জানি,আমাদের মানবসভ্যতার ইতিহাস থেকে আমরা জানতে পারি যে আমাদের সভ্যতার একেবারে আদিতে ছিল মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা। তখন নারীরাই ছিলেন সারা পৃথিবীতে সমস্ত জনগোষ্ঠীগুলির প্রধান। তারাই ছিলেন সর্বেসর্বা। পরবর্তী সময়ে পুরুষতান্ত্রিক সভ্যতার উদয় হওয়ার ফলে নারীদের গৃহবন্দী করার নানাভাবে প্রচেষ্টা করা হয়,এবং নানারকমের বিধিনিষেধ আরোপ করা হয় নারীদের ওপরে। যদিও বৈদিক যুগে আমরা উপনিষদের ইতিহাসে পাই,যে সেই সময়েও পুরুষ জ্ঞানী যাজ্ঞবল্ক্য, বশিষ্ঠ, বিশ্বামিত্র,গৌতম,জামদগ্ন, কপিল,কাশ্যপ, ভরদ্বাজ,শান্ডিল্য,বাৎস,বাল্মিকী,কণাদ,প্রমুখ মুনি-ঋষিদের পাশাপাশি অনেক নারীও মহাজ্ঞানী ছিলেন,যেমন,গার্গী,অরুন্ধতী,অপালা,মৈত্রেয়ী,জবালা,লীলাবতী,খনা,প্রমুখরা।
কিন্তু,এহেন অবস্থা থেকে পরবর্তী সময়ে সেই নারী সমাজকে পুরুষের কর্তৃত্বে থাকতে হয়েছে।কেড়ে নেওয়া হয়েছিল নারীর শিক্ষার অধিকার।ব্যক্তিগত পছন্দ অপছন্দের অধিকার। নারীকে ব্যবহার করা শুরু হোল সমাজের ক্রীড়ানক হিসাবে।নারীকে ব্যবহার করা শুরু হল সন্তান উৎপাদন,সন্তান পালন, ঘরের যাবতীয় কাজের জন্য,আর পুরুষের লালসার সামগ্রী হিসাবে। যুগের পর যুগ চলতে থাকলো সেইসব অত্যাচার।যার ইতিহাস পাই আমাদের এই বাংলাতেও।যেমন্য মেয়েদের বাল্যবিবাহ, সতীদাহ প্রথা,বাল্য-বিধবাদের জন্য নানান কঠোর সামাজিক বিধিনিষেধ, ইত্যাদি ইত্যাদি। শুধু বাংলায় নয়,সারা ভারতের বিভিন্ন জায়গাতে ছিল এবং আজও আছে মেয়েদের ওপরে এইরকম নানান অন্যায় অবিচারমুলক বিধিনিষেধ।ভারতের বাইরেও, সারা বিশ্বেই ছিল মেয়েদের ওপরে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের সমাজপতিদের হুকুমজারি। যা নিশ্চিতভাবেই সভ্যতার পরিপন্থী। যা ছিল অন্যায়,অত্যাচার স্বরূপ।বারবার বিভিন্ন সময়ে এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদী নারীরা, শুভবুদ্ধিসম্পন্ন পুরুষেরা বিদ্রোহ করেছেন। ইতিহাস থেকে আমরা জানতে পারি, ১৮৫৭ সালের ৮ই মার্চ আমেরিকার নিউইয়র্কে ৮ঘন্টা কাজের দাবীতে,পুরুষদের সমান মজুরীর দাবীতে,নারী পোশাক শ্রমিকদের এক প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। ১৯০৯ সালে ২৮শে ফেব্রুয়ারিতে নিউইয়র্কে আমেরিকান সোসালিষ্ট পার্টির থেরেসা মালকিয়েলের নেতৃত্বে নারীদিবস হিসাবে একটি আন্দোলন শুরু হয়। ১৯১০ সালে ক্লারা জেটকিন,কেট ডানকার,পলা থিয়ভ সহ অন্যান্য নারীরা নারীর অধিকারের দাবীতে নারী দিবস পালন করেন ডেনমার্কের কোপেনহেগেন শহরে। জার্মান দেশে রোজা লুক্সেমবার্গ নেত্রী হিসাবে নারীর অধিকারের দাবীতে আন্দোলন শুরু করেন।
১৯১১ সালে অস্ট্রিয়া, হাঙ্গেরি, জার্মান,ডেনমার্ক, সুইজারল্যান্ড, আমেরিকা,ইংল্যান্ড, রাশিয়া, পোল্যান্ড, ইটালি, স্পেন, পর্তুগাল, অস্ট্রেলিয়া, প্রভৃতি দেশে নারীর অধিকারের দাবীতে বিভিন্ন সময়ে,বিভিন্ন জায়গাতে সব মিলিয়ে প্রায় ২০ লক্ষ নারী বিক্ষোভে সামিল হন। তখন তৈরী হয় একটি নারী সংগঠন, যার নাম দেওয়া হয় International Women’s Democracy (IWD)। তারা দাবী তোলেন বিশ্বব্যাপী নারীর ভোটাধিকার, কাজের অধিকার,পুরুষদের সম পরিমাণ মজুরি, শিক্ষা,স্বাস্থের অধিকার, বাবা-মায়ের সম্পত্তিতে উত্তরাধিকার, যৌন নিগ্রহের বিরুদ্ধে সোচ্চার,ইত্যাদি। নেতৃত্বে আসেন ক্লারা জেটকিন,রোজা লুক্সেমবার্গ, আলেক্সান্দ্রা কোলন্তাই,ডলোরেস ইবারুরি,কেট ডানকার,পলা থিয়েভ,প্রমুখরা। দেশে দেশে সমাজতান্ত্রিক নেতৃবৃন্দ মহিলাদের এই দাবীগুলিকে সমর্থন করেন এবং তাদের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের সাহায্য সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন। দশকের পর দশক লাগাতার বারংবার বিভিন্ন আন্দোলন, বিক্ষোভ, বিদ্রোহ, ইত্যাদির ফলস্বরূপ রাষ্ট্রসংঘ ১৯৭৭ সালের ৮ই মার্চ দিনটিকে “নারী দিবস” হিসাবে সারা বিশ্বের ২০৩ টি দেশে প্রতি বছর পালনের কথা ঘোষণা করেন। নারীর সমানাধিকার এবং শান্তির জন্য নারী দিবস আজও পালিত হয়ে আসছে।
শেষ করি রবীন্দ্রনাথের একটি কবিতা এবং কাজী নজরুল ইসলামের একটি কবিতার অংশ উদ্ধৃত করে—
“নারীকে আপন ভাগ্য জয় করিবার /কেন নাহি দিবে অধিকার? /হে বিধাতা..”
(রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)।
“বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চিরকল্যানকর,
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী,অর্ধেক তার নর।”
(কাজী নজরুল ইসলাম)।
শুভেচ্ছা অভিনন্দন রইল সকল নারীদের জন্য।ভালো থাকুন আপনারা,কারন আপনারা ভালো থাকলে তবেই এই সমাজ,সভ্যতা ভালো থাকবে।কারন আপনাদের কোলেই জীবনের সৃষ্টি,আপনাদের আদরেই জীবনের লালন পালন।
বিনম্র শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা রইল।