প্রথম পাতা প্রবন্ধ মাগো, তোমার চরণ ছুঁয়ে যাই “শ্রীশ্রী মা সারদা”

মাগো, তোমার চরণ ছুঁয়ে যাই “শ্রীশ্রী মা সারদা”

50 views
A+A-
Reset

পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়

আজ থেকে ১৭২ বছর আগে আমাদের এই বাংলা তথা ভারতীয় সমাজ নানা সংষ্কার, বিধিনিষেধই তখন গভীরভাবে আচ্ছন্ন। সমাজে জাতপাতের সমস্যা, অশিক্ষা-কুশিক্ষা,
অকাল বৈধব্য, বাল্যবিবাহ, মেয়েদের তো বটেই পুরুষদেরও কোনও শিক্ষার প্রচলন নেই, কেমন যেন এক জড়তায়, কূপমন্ডুকতায় আবদ্ধ সেই সময়ের সমাজ ব্যবস্থা। চারিদিকে এক জমাট বেঁধে রয়েছে অন্ধকার। মেয়েদের তো আরও করুণ অবস্থা। তাদের জন্য রান্নাঘর আর আঁতুরঘর। পুরুষ শাসিত সমাজ ব্যবস্থা নারীদের কোনও সম্মানই দিতো না বললেই চলে। এইরকম এক সময়কালে এবং এই প্রকারের সেই সমাজ ব্যবস্থায় ২২ শে ডিসেম্বর, ১৮৫৩ সালে( ৮ ই পৌষ,১২৬০ বঙাব্দে) বাংলার এক আটপৌরে, নিভৃত পল্লীগ্রামে,বাঁকুড়া জেলার জয়রামবাটিতে এক গরীব দম্পতির ( রামচন্দ্র মুখোপাধ্যায় এবং শ্যামাসুন্দরী দেবী) কোলে জন্ম নিয়েছিলেন এক কন্যা, যার প্রথমে নাম ছিল ক্ষেমঙ্করী, পরে নামকরণ করা হয় সারদামণি।

সেই সময়ের আর পাঁচটা সাধারণ পল্লীবালিকার মতোই, একান্নবর্তী পরিবারে বড় হওয়া, সকলের সাথে সুখেদুখে একসাথে পাশাপাশি থাকা,প্রথাগত কোনও বিদ্যাশিক্ষাও নেই,আর সামাজিক রীতিনীতি মেনে বাল্য বয়সেই (মাত্র ৬বছর বয়সে) বিবাহ হয়ে যাওয়া। বিবাহ হলো ১৮/১৯ বছরের বড়ো কামারপুকুরের গদাধর চট্টোপাধ্যায়, তথা কলকাতায় জানবাজারের রানী রাসমণী দেবী প্রতিষ্ঠিত দক্ষিণেশ্বরের মা ভবতারিণী দেবীর পূজারী বামুন,একটু অন্যধরনের মানুষ “ছোট ভটচায্যি” মশায়ের সাথে।

এই অবধি ইতিহাস খুবই গুরুত্বপূর্ণ একথা কি বলা যায়? না বলা যায় না। কিন্তু বাবা মায়ের আদরের কন্যা “সারু” তো আর যে সে নন,তিনি যে স্বয়ং জগজ্জননী।যেমন দক্ষিণেশ্বরের পুজারী ছোট ভটচায্যি মশাইও যে স্বয়ং পরমপুরুষ শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব, যিনিই স্বয়ং ভগবান।পরমলীলার জন্যে নেমে এসেছিলেন মানবশরীর ধারণ করে এই জগতের কল্যানে।স্বয়ং নারায়ন,স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ, স্বয়ং শ্রীরামচন্দ্র,স্বয়ং দেবাদিদেব মহাদেব,যে একদেহে লীন হয়েছেন শ্রীরামকৃষ্ণ রূপে।সেই তাঁর লীলা সঙ্গিনী হিসাবে মা সারদা তো স্বয়ং জগন্মাতা জগদ্ধাত্রী জগৎজননী।

মা সারদা এলেন এক সমন্বয়ের বারতা নিয়ে। ভেদাভেদের বিনাশ সাধনে তিনিই হলেন অগ্রদুতী।

লৌকিকভাবে একান্নবর্তী পরিবারে ভায়েদের, বাপমরা ভাইঝি রাধুর,আশেপাশের সকলের তিনিই আশ্রয়। আবার তিনিই শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের সাধনার আনন্দময়ী দেবী।সেই তিনি আবার পরবর্তীতে সারা বিশ্বে শ্রীরামকৃষ্ণ মিশনের সঙ্ঘজননী।মায়ের কাছে এদেশের,বিদেশের সকলের জন্য আশ্রয়ের আঁচলপাতা,যেন বিশ্বমায়ের,বিশ্বময়ীর আঁচল পাতা। তিনি কুটনো কুটছেন,রান্না করছেন,সবাইকে খাওয়াচ্ছেন,কে খেল,না খেল তার তদারকি করছেন,ভেদাভেদহীন ভাবে এঁটো কুড়িয়েছেন,বাসন মেজেছেন।আবার নিত্য ঠাকুরের সেবা,পুজা,করেছেন।দেখভাল করেছেন অবলা প্রাণীদের সন্তানের মতো।

সেকালে অব্রাহ্মণদের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতো না ব্রাহ্মণরা। এই প্রথা তিনিই ভাঙলেন।সকলকে ঈশ্বরজ্ঞানের এক অনন্যসাধারণ দৃষ্টান্ত। রাধুকে বলছেন, এক বয়স্ক কবিরাজ কে প্রণাম করতে। কবিরাজ ছিলেন অব্রাহ্মণ। কুণ্ঠিত রাধুকে শ্রীমা বললেন,- “কবিরাজ মশাই,কত জ্ঞানী, কতো বড়ো, তাঁকে প্রণাম করতে হবে।”

তখন অহিন্দুদের ম্লেচ্ছ বলা হোত সমাজে।সাগরপারের মার্গারেট এলিজাবেথ নোবেল (ভগিনী নিবেদিতা),মিস জোসেফিন ম্যাকলাউড,মিসেস সারা ওলি বুল,মিসেস স্যেভিয়ার,প্রমুখদের কাছে টেনে নিলেন মায়ের ভালোবাসায়,মায়ের আদরের স্নেহে। নিবেদিতাকে তো ডাকতেই শুরু করলেন “আমার খুকী” বলে।
এসবই আজকের বিচারে দেখলে চলবে না।দেখতে হবে আজ থেকে ১৫০/১২৫ বছর আগের তখনকার এই বাংলা তথা এই ভারতবর্ষের সামাজিক পরিপ্রেক্ষিতের প্রেক্ষাপটের বিচারে। স্বামী বিবেকানন্দ একটি চিঠিতে লিখছেন– “শ্রীশ্রীমা এখানে(কলকাতায়) আছেন। ইউরোপীয়ান,আর আমেরিকান মহিলারা তাঁকে দেখতে গিয়েছিলেন।ভাবতে পারো,মা তাঁদের সঙ্গে একসাথে খেয়েছিলেন?”

ভাবা যায় সেই যুগের একজন গ্রাম্য বিধবা নারী তৎকালীন সমাজের সমস্তরকম কুসংষ্কারের,কূপমন্ডুকতার বেড়াজাল ভেঙ্গে বিশ্বমাতা রূপে, জগজ্জননী রূপে কাছে টেনে নিয়েছিলেন সেইসব বিদেশিনীদের।

মায়ের ভাইঝি রাধুর পোষা বেড়াল ছিল,মা রোজ তার জন্যে একপোয়া করে দুধের ব্যবস্থা করেছিলেন।বেড়ালটি মায়ের পায়ের কাছে শুয়ে ঘুমোতো।একদিন এক সন্ন্যাসী বেড়ালটিকে তাড়িয়েছিল।মা কিন্তু মনঃক্ষুন্ন হয়েছিলেন,বলেছিলেন সেই সন্ন্যাসীকে,-“শোনো বাবা, ওর মধ্যেও আমি আছি।” কি অমোঘ সত্য অনুভবে মায়ের এই কথার অন্তরলীন অর্থ।

আর সেই ঘটনা তো আমরা সবাই জানি,ঘর সারানোর জন্যে মুসলিম ঘরামী আমজাদকে কাজের পরে মা নিজের হাতে আসন পেতে খেতে বসালেন,খাওয়াবেন নিজে সামনে বসে।মায়ের এক ভাইঝি নলিনী আমজাদের পাতে খাবার দিচ্ছে একটু দুরত্ব বজায় রেখে, ছুঁড়ে ছুঁড়ে।তাই দেখে মা ক্ষুন্ন হয়ে বলেছিলেন –“ওকিরে? ওই ভাবে কেউ কাউকে খেতে দেয়? তুই আমাকে দে সব আমি দিচ্ছি।” এই কথা বলে মা নিজে আমজাদকে পরিবেশন করতে লাগলেন।খাওয়ার শেষে আমজাদ এঁটো পাতা তুলে নিয়ে যাওয়ার পরে সেই জায়গা মা স্বয়ং নিজের হাতে পরিষ্কার করছেন দেখে উপস্থিত সকলে বলেছিলেন,”ওকি কি করছো গো? মুসলমানের এঁটো কাড়লে? তোমার আর জাত টাত কিছু রইল না গো…”। এই কথার উত্তরে মায়ের সেই চিরন্তন শাশ্বত বাণী– “আমার শরৎ যেমন ছেলে,এই আমজাদও তেমনই আমার ছেলে।” তার মানে শরৎ মহারাজ, যিনি সন্ন্যাসী প্রবর স্বামী সারদানন্দ আর মুসলিম ঘরামী আমজাদ দুজনেই মায়ের কাছে এক,অর্থাৎ সমদৃষ্টিতে মায়েরই সন্তান।এই না হোলে বিশ্বমাতা?

যে সমাজে ভাতের হাঁড়িতে আর হুঁকোর জলে জাতপাতের রেষারেষিটা চলে,যে সমাজ-এ জাতের নামে বজ্জাতি করে জাত-জালিয়াতির জুয়া খেলা হয়,আজকের পরিস্থিতিতে যখন জাতপাত আর ধর্মের জিগির তুলে,ধুয়ো তুলে,মানুষ মানুষকেই হত্যা করে,ঘর জ্বালিয়ে দেয়,নারীদের বেইজ্জত করে,সেই পরিস্থিতিতে শ্রীশ্রী মায়ের এই সকল দৃষ্টান্তগুলি আমাদের এক নতুন পথের,এক নতুন সমন্বয়ের দিশা দেখায়।

আমাদের শ্রীমা-কে তাই কোনও জাতের,ধর্মের সংকীর্ণ মানসিকতার গন্ডীতে সীমাবদ্ধ করে রাখা যাবে না। কারণ তিনিই আমাদের সকলের “মা”। তিনিই কালী,তিনিই দুর্গা,তিনিই আমিনা,ফতেমা,তিনিই মেরী,মরিয়ম। তিনি মা,তিনি আম্মিজান,তিনি মাদার,তিনি আই,।তাই শ্রীমায়ের চরণ ছুঁয়ে বলে যেতে ইচ্ছে হয়,

“..তোমাতে বিশ্বময়ীর,তোমাতে বিশ্বমায়ের আঁচল পাতা।”
মাগো আমার,তুমি ছিলে,আছো, থাকবেও চিরদিন আমাদের অন্তরে অন্তরে, আমাদের আশ্রয় রূপে। আজ তোমার পূণ্য শুভ আবির্ভাবের মহাদিনে তোমার চরণে ঠেকাই মাথা।

মাগো প্রণাম তোমায়।
মাগো প্রণাম তোমায়।
মাগো প্রণাম তোমায়।

মন্তব্য করুন

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

সম্পাদকের পছন্দ

টাটকা খবর

©2023 newsonly24. All rights reserved.