সাহিত্যিক তথা বিপ্লবী প্রতিভা বসু

প্রতিভা বসু। ছবি সৌজন্য আনন্দবাজার পত্রিকা

পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়

চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের (১৯৩০ সালে) নায়ক মাস্টারদা সূর্য সেনের অন্যতম সাথী অনন্ত সিংহের ফাঁসির অর্ডার হয়েছে…কিন্তু গোপনে চেষ্টা করা হচ্ছে যদি বড় উকিল দিয়ে উচ্চ আদালতে গিয়ে ফাঁসির অর্ডার রদ করা যায়। কিন্তু তার জন্যে তো অনেক টাকার দরকার, কি করে সেই টাকা জোগাড় হবে? শেষমেশ ঢাকার বিপ্লবী দলের অন্যতমা নেত্রী লীলা নাগ বললেন, “আমার এক ছোট বোন আছে, তাকে গোপনে দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে, সে আমারই হাত ধরে আমাদের দলের সাথে যুক্ত হয়েছে, খুব ভালো মেয়ে, দায়িত্বশীলাও সে খুব।” এই লীলা নাগ নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর অনুগামী ছিলেন। নেতাজির স্নেহধন্যাও ছিলেন, পরে বিপ্লবী অনিল রায়কে বিয়ে করেন।

যাইহোক, লীলা নাগের প্রস্তাব মতো কাজ শুরু হল, একটি ১৫/১৬ বছরের মেয়ের ওপর দায়িত্ব পড়ল টাকা জোগাড়ের। খুব ভালো গান গাইতে পারত মেয়েটি, আর সেই গান গেয়েই টাকার জোগাড় করেছিলেন মেয়েটি, টাকার বন্দোবস্তও হয়েছিল সেদিন। সেই মেয়েটিও নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর খুব স্নেহের পাত্রী ছিলেন।

সেই মেয়েটির নাম প্রতিভা সোম। বাবার নাম ছিল আশুতোষ সোম, আর মায়ের নাম সরযুবালা সোম। প্রতিভার জন্ম হয় ১৯১৫ সালের ১৩ মার্চ। তিনি অবিভক্ত বাংলার ঢাকা বিক্রমপুর পরগনার হাঁসাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। পড়াশোনার পাশাপাশি তিনি সঙ্গীতচর্চাও করতেন খুবই দক্ষতার সঙ্গে। তিনি গান শিখেছিলেন পণ্ডিত চারুদত্ত, প্রফেসর গুল মহম্মদ, মেহেদি হোসেন, পণ্ডিত ভোলানাথ মহারাজ, দিলীপ কুমার রায়,কাজী নজরুল ইসলাম, হিমাংশু দত্তের মতো গুণীজনদের কাছে। শুধু তাই নয়, তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সান্নিধ্যেও এসেছিলেন গানের তালিম নেওয়ার জন্য। মাত্র ১১/১২ বছর বয়সে প্রতিভা দেবী এইচএমভি কোম্পানিতে গানের রেকর্ড করেছিলেন।

বাংলা সাহিত্যের অন্যতম সাহিত্যিক কল্লোল যুগের অন্যতম পথিকৃৎ বুদ্ধদেব বসুর সঙ্গে বিয়ের পরে প্রতিভা দেবী গান গাওয়া ছেড়ে সাহিত্য সাধনায় নিজেকে নিয়োজিত করেন।

প্রতিভা বসুর লেখা উপন্যাসগুলির মধ্যে অন্যতম হল… “অতল জলের আহ্বান”, ” পথে হল দেরী”, “আলো আমার আলো”… ইত্যাদি। তিনি ছোট গল্প, প্রবন্ধ, ইত্যাদি লেখাতেও অত্যন্ত পারদর্শী ছিলেন।

তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের “ভুবনমোহিনী স্বর্ণ পদক” সম্মানে সম্মানিতা হয়েছিলেন। প্রতিভা বসু “আনন্দ” পুরস্কারে পুরস্কৃত হয়েছিলেন। বাংলা সাহিত্যের অন্যতমা নক্ষত্র ছিলেন প্রতিভা বসু। তাঁর দুই কন্যা…মীনাক্ষী এবং দময়ন্তী আর এক পুত্র,নাম শুদ্ধশীল।

প্রতিভা বসু নিজে দু’টি পত্রিকা সম্পাদনা করতেন…সগুলি হল “বৈশাখী” এবং “ছোটগল্প”। প্রতিভা বসু বাংলা সাহিত্যের অঙ্গনে এক স্বর্ণাক্ষরে লেখা নাম, যে নাম বাংলা ও বাঙালি চিরকাল শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবে।

সেই প্রতিভা বসু ২০০৬ সালের ১৩ অক্টোবর আমাদের সমস্ত মায়ার বন্ধন ছিন্ন করে অমৃতলোকে চিরদিনের জন্য মহাপ্রস্থান করেন।

তাঁর প্রতি রইল আমাদের প্রণাম।

Related posts

‘কলকাতার যীশু’, ‘উলঙ্গ রাজা’, ‘অমলকান্তি’-র প্রণেতা, শতবর্ষী কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী

চৈত্র বৈশাখ মধুমাধবের মায়ায় মায়ায়

রবীন্দ্রনাথের ‘সখা’ এবং আতুর আর্ত ব্রাত্যজনের ‘দীনবন্ধু’ এন্ড্রুজ