পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়
সেই কবে অন্নদাশঙ্কর রায় লিখে গেছেন “ভুল হয়ে গেছে, ভুল হয়ে গেছে বিলকুল/সব কিছু ভাগ হয়ে গেছে,ভাগ হয়নি কো নজরুল। “
আচ্ছা কাজী নজরুল ইসলাম-কে কি তাঁর নামের মাধ্যমে মূল্যায়ন করা যায়? যেহেতু নামটা মুসলিম সম্প্রদায়-ভুক্ত,তাই তিনি কি মুসলিম?
উত্তর কক্ষনোই না। আবার, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-কে কি হিন্দুত্ব দিয়ে মূল্যায়ন করা যায়? শুধু নামটা হিন্দু সংস্কৃতিভুক্ত বলে? উত্তরটা এখানেও সেই একই –না কক্ষনোই না।
আসলে আমরা বাঙালীদের বুক ঠুকে বলা উচিত আমরা রবীন্দ্রনাথ নজরুলের উত্তরসূরীর জাত। আমাদের ভাষা রবি ঠাকুর -কাজী নজরুলের ভাষা। আমাদের এই মাটিতে তাই বিভেদের কোনও ঠাঁই নেই,আমাদের এখানে সম্প্রীতির মঙ্গলারতির শঙ্খ-ঘন্টা বাজে আজানের সাথে সাথে নামাজের সুরে সুরে।
কাজী নজরুল ইসলাম আমাদের সংস্কৃতির আরেক নাম। এই অবিভক্ত বাংলার বর্ধমানের আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে এক হত দরিদ্র পরিবারে কাজী নজরুল ১৮৯৯ সালের ২৪শে মে( ১১ই জ্যৈষ্ঠ, ১৩০৬ বঙ্গাব্দ) জন্মগ্রহন করেছিলেন। বাবা ছিলেন স্থানীয় মসজিদের ইমাম কাজী ফকির আহমেদ,আর মা ছিলেন জাহেদা খাতুন। এই “নজরুল” নামের অর্থ হলো “আল্লাহ্-র নামে শপথ”।
অল্প বয়সে পিতৃহারা হন নজরুল। শুরু হয় জীবনযুদ্ধ। পড়াশোনা খাপছাড়া খাপছাড়াভাবে হোল। ছোটবেলা থেকেই কাজের জন্যে,কখনো পাঁউরুটির কারখানায়,কখনো লোকের বাড়িতে খিদমদগার হিসাবে কাজ করার মধ্যেই যখন যেখানে পড়াশোনা করতে পেরেছেন,তাই করেছেন।আবার কখনো যাত্রার দলে,লেঠোদের দলে ভিড়ে গিয়ে কয়েকটা দিন যাযাবরের মতোও নিজেকে সরিয়ে নিয়েছেন সমাজ থেকে।
এইভাবে চলতে চলতে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে নজরুল ইসলাম হাবিলদার সৈনিক হিসাবে ঢুকে পড়েন ৩৯ নম্বর বেঙ্গলী ব্যাটেলিয়নের একজন হিসাবে।
চলে যান করাচী। সেনা জীবনেই নজরুলের কাব্য-সাহিত্য প্রতিভার প্রকাশ ঘটে। তিনি যেমন বাংলা সাহিত্য,বিদেশী সাহিত্য পড়তে শুরু করবন, তেমনি সঙ্গীতের প্রতিও আকর্ষণ নজরুলের ক্রমে ক্রমে বাড়তে শুরু করেছিল।
তারপর,১৯২০/২১ সালে বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়ে গেলে তিনি করাচী থেকে চলে আসেন কলকাতায়। এখানে ৩২ নম্বর দিলখুশা স্ট্রীটের একটি মেসে থাকতে শুরু করেন,পরে তালতলা স্ট্রিট-এ।সেই সময়ে কাজী নজরুলের সহসঙ্গী ছিলেন ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের অন্যতম প্রাণপুরুষ মুজফফর আহমেদ।
কলকাতাতেই নজরুলের কাব্য সাহিত্য প্রতিভার বিচ্ছুরন। দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়লো নজরুলের নাম। স্বয়ং কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হয়ে উঠলেন কাজী নজরুল ইসলামের অন্যতম একজন গুণমুগ্ধ।
নজরুল গান লেখা আর সুর করায় ধীরে ধীরে পারদর্শী হয়ে উঠলেন।যোগ দিলেন গ্রামাফোন কোম্পানিতে। নজরুলের গান ছড়িয়ে পড়ল চারিদিকে।বাঙালীর সংস্কৃতিতে স্থায়ী আসন প্রতিষ্ঠিত হোল কাজী নজরুল ইসলামের। নজরুলের কবিতায় দেশ মাতৃকার বন্দনা,বিদ্রোহের গান,কবিতা সেই সময়ের দেশের পরাধীনতার বিরুদ্ধে স্বাধীনতার আন্দোলনে যুক্ত বিপ্লবীদের মুখে মুখে মুখরিত হতে লাগল। ততদিনে নজরুল বিয়ে করে সংসার করেছেন।তিনি পড়লেন ব্রিটিশ রাজশক্তির রোষানলে।
যেতে হোল ব্রিটিশদের কারাগারে। জীবনের চলার পথে অনেক অনেক ঝড় ঝাপটার মুখোমুখি হয়েছেন।
যখন সন্তান বুলবুল অকালে মারা গেল,তখন নজরুল হুগলি জেলে। সন্তানের লাশ দফন (কবর) করার জন্য ১৫০ টাকার প্রয়োজন, তাও ছিল না নজরুলের কাছে। শেষে দাদাঠাকুর (শরৎচন্দ্র পণ্ডিত), ভগৎ সিং-এর এক পরমাত্মীয় সর্দার কর্তার সিং,এবং এক খ্রিস্টান বন্ধু টাকা জোগাড় করে সেই কাজ সমাধা করেন।
কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন শিকল ভাঙার গানের স্রষ্টা, বিদ্রোহের কবি,আবার পাশাপাশি ছিলেন এক উচ্চস্তরের সাধক– তাই তিনি লিখতে পারেন– “আমার কালো মেয়ের পায়ের তলায় দেখে যা আজ আলোর নাচন”, কিম্বা, ” ওরে মন রমজানের এই রোজার শেষে এলো খুশীর ঈদ রে..”,
ইত্যাদি ইত্যাদি।
কাজী নজরুল ইসলামের কথা বলতে শুরু করলে শেষ হবার কোনও সময় থাকবেই না। কারন এক বিশাল প্রতিভার মানুষ তিনি। সাম্প্রদায়িক মানসিকতা ছিল না। তাই বলা যায়,সারা বিশ্বে একমাত্র অসাম্প্রদায়িক ব্যক্তি,কবি,সাহিত্যিক,গীতিকবি ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম।
কাজী নজরুল ইসলামের ছদ্মনামগুলি দেখলেই বোঝা যাবে–“ধুমকেতু”(এই নাম দিয়েছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ), “উন্মাদ” (এই নামে ডাকতেন বন্ধু শৈলজারঞ্জন মুখোপাধ্যায় এবং শৈলেন্দ্রনাথ ঘোষ),
” নুরু”, ” নরু”, “তারাক্ষ্যাপা”, ” নজরুল এছলাম”,
” মোহাম্মদ লোক হাসান”, “বাগনান”, কল্হন মিশ্র,।
১৯৪১ সালে কবিগুরুর মহাপ্রয়াণের ধারাবিবরণী রেডিও থেকে দিয়েছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম এবং বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্র।
১৯৪২ সালে রেডিওতে সন্ধ্যেবেলায় ঘোষণার কাজ করতে করতে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন,আর সেই স্নায়ুর অসুস্থতা আমরণ ছিল নজরুলের সঙ্গী।সেই অসুখ নিরাময় হয়নি কোনওদিন।তিনি পূর্ব কলকাতার ক্রীষ্টোফার রোডের ভাড়াবাড়ীতে থাকতেন। এক নীরব,নির্বাক মানুষ হোয়ে। যদি কখনো কেউ নজরুলের কবিতা পড়তেন তাঁর সামনে,বা নজরুলের গান গাইছেন,তখন তাঁর দুচোখে নামতো অশ্রুধারা। সে এক মর্মান্তিক করুণ দৃশ্য।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশ রাষ্ট্র জন্ম নেওয়ার পরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান কাজী নজরুল ইসলামকে সসম্মানে নিয়ে যান। সেখানেই ঢাকাতে ২৯ আগস্ট ১৯৭৬ সালে (১২ই ভাদ্র,১৩৮৩ বঙ্গাব্দ) কাজী নজরুল ইসলামের মহাপ্রয়াণ ঘটে।
আজ কাজী নজরুল ইসলামের মহাপ্রয়াণ-এর ৫০ বছর অতিক্রমনের প্রাক্কালে বাঙালির ঘরে ঘরে,এপার ওপার দুই বাংলায় প্রতিষ্ঠিত হোক পারস্পরিক মেলবন্ধনের বিনিসুতোর মালায় গাঁথা সম্প্রীতির অনিন্দ্যসুন্দর মালাখানি।
যে মালায় আমাদের ভালোবাসা,ঐতিহ্য মাখামাখি হয়ে থাকুক কাজী নজরুল ইসলামের জন্মদিনের সুরভিত সুষমা আর মহাপ্রয়াণ-এর ব্যাথা বিদুর বেদনা।
“আমরা হিন্দু নই,আমরা মুসলিম নই, আমরা মানুষ,শুধুই মানুষ,নেই কোনও জাতপাত,/
আমাদের চেতনায় আছেন চিরদিন কাজী নজরুল ইসলাম ,আর,
হৃদয়-মাঝে আছেন রবীন্দ্রনাথ।” (শতদল)
বাঙালির বিনম্র শ্রদ্ধা রেখে গেলাম কাজী নজরুল ইসলামের শুভজন্মদিনের শুভক্ষণের পদপ্রান্তে।