পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়
বাংলা ও বাঙালির উঠোন জুড়ে উৎসবের শুরু হয় ভাদ্রমাসে বা বলা যায় সেপ্টেম্বরের ১৭ তারিখে বিশ্বকর্মা পুজো থেকে। কেননা তার পরেই মহালয়া, আর তার ৭দিন বাদেই মহাষষ্ঠী… মা দুর্গার আগমন। আনন্দের আবেগ আর উচ্ছ্বাস বাংলার মনে মনে আর ঘরে-বাইরে। কিন্তু এখানেই শেষ নয়, তারপর আসে কোজাগরী লক্ষ্মী পুজা আর যেই সেই পুজো শেষ হবে অমনি কালী পুজোর প্রস্তুতি। নানারকমের রঙিন রঙিন আলোর ঝলকানিতে আতসবাজির রমরমা আকাশের আঙিনায়, বাতাসের আলো-আঁধারিতে।
এই কালীপুজো কিন্তু বাংলা তথা ভারতজুড়ে অতি প্রাচীন কাল থেকেই হয়ে আসছে। এই দেবী মা কালিকার আরাধনা সেই প্রাচীন কালে করেছেন বশিষ্ঠমুনি, বিশ্বামিত্র মুনি,কশ্যপমুনি, ঋষি অঙ্গিরা, ঋষি কাত্যায়ন….প্রমুখরা।
এ সবের উল্লেখ পাওয়া যায় কালিকা পুরাণে, কালিকা মঙ্গল কাব্য প্রভৃতিতে।
কার্তিক মাসের অমাবস্যায় এই পুজো হয়। সেদিন ঘনঘোর তমসাচ্ছন্ন ধরণীর বুকে আলোর ঝলকানিতে, আলোর রোশনাইতে মায়ের পুজো অনুষ্ঠিত হয় মিশকালো অমা-নিশায়।
কথিত আছে, এই পুজো নাকি হাজার হাজার বছর আগের পুজো। অনার্যদের পুজো ছিল এই কালী পুজো। পরে বৈদিক সভ্যতায় এই পুজো অনার্য- আর্য সমাজে সম্মিলিতভাবে হতে শুরু হয়। এখন এই পুজো বাংলা তথা সারাদেশে সর্বজনীন। ঘরে ঘরে, মণ্ডপে মণ্ডপে।
কালীপুজো সারা বিশ্বে বিভিন্ন নামে,বিভিন্ন দেশে হয়। এই পুজো আমাদের দেশের অনেক মহাপুরুষ মহাসাধকগণ করে গেছেন। যেমন,সাধক রামপ্রসাদ, সাধক আত্মারাম,সাধক ব্রহ্মানন্দ, সাধক কমলাকান্ত, সাধক বামাক্ষ্যাপা (বামদেব), সাধক ভবা পাগলা,সাধক শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব, শ্রীমা সারদামণি দেবী, মা আনন্দময়ী, সাধিকা রানি রাসমণি, সাধক কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ (শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভুর সমসাময়িক), প্রমুখ।
দেবী মা দুর্গার সতীরূপের যে কাহিনি, সেই কাহিনি অনুসারে যেখানে যেখানে সতীর অঙ্গ ভুপাতীত (পড়েছিল) হয়েছিল, সেই সব পবিত্রস্থানে দেবীমায়ের প্রতিষ্ঠা হয়। সেই ৫১ সতীপীঠের সর্বত্র কালী পুজোর দিন সারারাত দেবী মায়ের পুজো হয়। বিভিন্ন নামে,বিভিন্ন মূর্তির মাধ্যমে।
দেবী কালিকার আরাধনা সংক্রান্ত অনেক তথ্য পাওয়া যায় কালিকা পুরাণে, কালিকা তন্ত্রসার-এ, কালিকা মঙ্গল কাব্যে,কালী মাহাত্ম্য, প্রভৃতি আদি প্রাচীন গ্রন্থ সমুহ-তে।
স্বামী বিবেকানন্দ দেবী কালিকাকে নিয়ে একটি স্তোত্রগান কবিতা..” Kali The Mother” লিখেছিলেন। আর সেই কবিতার ব্যখ্যা করেছিলেন ভগিনী নিবেদিতা কালীঘাটের মন্দির প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে ১৯০৪ সালে কালীপুজোর দিনে। সেখানে সেদিন উপস্থিত ব্যক্তিত্বদের মধ্যে ছিলেন বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু,ভুপেন্দ্রনাথ দত্ত (স্বামী বিবেকানন্দ-এর ছোট ভাই), ফ্রান্সের দার্শনিক চার্লস ফ্রেডেরিক এন্ড্রুজ, সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্র বসু (নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর মেজ দাদা), লেডি অবলা বসু (বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসুর সহধর্মিণী) ,শ্রীমতি সুধীরা দেবী (শ্রী মা সারদার মন্ত্র শিষ্যা), শ্রীমতি মৃণালিনী দেবী (ঋষি অরবিন্দের সহধর্মিনী),…প্রমুখরা।
সে এক অনিন্দ্যসুন্দর ইতিহাস।
কালী আরাধনা ছিল অন্যতম শক্তির আরাধনা আমাদের দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের বীর বিপ্লবীদের। কারন,সেই অগ্নিযুগে বিপ্লবীদের গোপন আস্তানায় কালীপুজোর দিনে দেশমাতৃকার নামে শপথ নিয়ে দেশমায়ের অমর বীর বিপ্লবী সন্তানরা মায়ের পরাধীনতার শৃংখল ছিন্ন করার জন্য নিজেদের জীবন উৎসর্গ করার মন্ত্রে নিজেদের দীক্ষিত করতেন।
এ ছাড়া অনেক অনেক বছর আগে এই কালী সাধনা করেই বাংলার গরিব মানুষের বন্ধু আর অত্যাচারী শাসকের আর তার বশংবদ রাজা, উজির, সামন্ত প্রভু,বা জমিদারদের যম এই বাংলার রঘু ডাকাত,বিশে ডাকাত,চিত্ত বা চিতে ডাকাত (যার নামে চিৎপুর), মনোহর ডাকাত (মনোহর পুকুর রোড), রানা ডাকাত (যার নামে রানাঘাট)…অমাবস্যার রাতে ডাকাতি করতে যেত।
এই রকমই একটি ঘটনায় শ্রীমা সারদা তখন মাত্র ১২/১৩ বছরের, যাত্রীদের সাথে দক্ষিণেশ্বরের দিকে আসার সময়ে একটু পিছিয়ে পড়েছিলেন,আর সন্ধ্যের অন্ধকারে সিঙ্গুর-তারকেশ্বরের কাছে তেলোভেলোর মাঠের জঙ্গলে আমজাদ ডাকাতের মুখোমুখি হয়েছিলেন,ডাকাত সর্দার মা সারদার মধ্যে সেদিন দেবী মা কালীকে দেখেছিলেন, আর সেইরাতে বালিকা সারদাকে ডাকাতদের বাড়ির মহিলারা নিজেদের মেয়ে হিসাবে চালভাজা,বাতাসা,নাড়ু খাইয়ে,সারা রাত নিজেদের কাছে আগলে রেখেছিলেন মায়ের স্নেহে। শোনা যায়, এই আমজাদ এবং তার সাগরেদরা এর পর সেই ডাকাতি একেবারে ছেড়ে দিয়ে সাত্ত্বিক জীবন যাপনে শ্রীমায়ের চরণে নিজেদের আজীবন সঁপে দিয়েছিলেন। মায়ের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। বস্তুত রাখাল মহারাজ (স্বামী রামকৃষ্ণানন্দ) এবং আমজাদ মহারাজ(স্বামী আহমদানন্দ)..এই দুইজনের তত্বাবধানেই শ্রীমা থাকতেন।
এই রকমই আর একটি ঘটনা ঘটেছিল সাধক রামপ্রসাদ এবং রানা ডাকাতের মধ্যে। যেখানে অমাবস্যায় নরবলি দেওয়ার জন্যে রামপ্রসাদকে ধরে এনে তাঁকে বলির হাঁড়িকাঠ-এ মাথা ঢোকানোর আগে রামপ্রসাদ একটি গান গাওয়ার শেষ অনুরোধ রানা ডাকাতের কাছে করেছিলেন…গানটি সেই মুহূর্তে তিনি সামনে জগজ্জননীকে সাক্ষী রেখে তৈরি করেছিলেন এবং গেয়েও ছিলেন…আর রানা ডাকাত দেখেছিলেন যে যাকে বলি দিতে তাঁরা উদ্যত, তাঁর গালে নিজের গাল ঠেকিয়ে হাঁড়িকাঠ-এর কাছে বসে আছেন জগজ্জননী মা কালী…আর গানটি ছিল.. “তিলেক দাঁড়া, ওরে শমন,… বদন ভরে একবার মাকে দেখি….”।
সেইরাতেই নেমেছিল ঝড় বৃষ্টির প্রলয়। রানা ডাকাতের মাতৃদর্শন ঘটেছিল সেদিন। রানা ছেড়ে দিয়েছিল ডাকাতি করা। মায়ের আরাধনা করেই সেই নদীর পাড়ে সারা জীবন কাটিয়েছিলেন রানা ডাকাত। সেই ঘাটের নাম হয়ে গেল রানাঘাট।
এ সব এই বাংলার এক একটি ইতিহাস, বাংলার কালীপুজোকে কেন্দ্র করে। তাই দুর্গাপূজার মতোই এই কালীপুজোও বাংলা তথা ভারতীয় সংস্কৃতির একটি ঐতিহ্য সম্বলিত উৎসব। তবে, হিন্দি বলয়ে এই সময়ে দিওয়ালি বা দীপাবলি খুব জনপ্রিয় পরব। বাংলাতে এবং সারা দেশে ঘরে ঘরে জ্বলে ওঠে প্রদীপ,মোমবাতির আলো। সেজে ওঠে ঘর দোর, ছাদ, উঠোন, বারান্দা। নানান আলোর রোশনাইতে পোড়ানো হয় আতশবাজি।
কথিত আছে যে এইদিন নাকি শ্রীরামচন্দ্র ১৪ বছর বনবাস কাটিয়ে রাবণ বধ করে সীতাকে উদ্ধার করে,সাথে নিয়ে অযোধ্যাতে ফিরেছিলেন,তাই সারা দেশ পথের অন্ধকার দূর করতে আলোক সজ্জায় সজ্জিত করেছিলেন চারিপাশ, চারিদিক। আনন্দে মেতে উঠেছিল জনগণ।
সে যাইহোক, কালীপুজো, শ্যামাপুজো,ধনতেরাস, লক্ষ্মী- গণেশপুজো, দিওয়ালি, দীপাবলিকে কেন্দ্র করে আলোকসজ্জায় সেজে ওঠা…এ এক অনির্বচনীয় আনন্দ,আবেগের উচ্ছ্বাস।
তাই এই সময়ে কামনা করি, সকলে ভালো থাকুন, সকলে আনন্দে থাকুন, সাবধানে থাকুন। সতর্ক থকুন। আর অনুরোধ করি, মনে রাখবেন আপনার আনন্দ উচ্ছাস যেন কোনওভাবেই অন্যের কোনও রকমের অনিষ্টতার,অসহনীয়তার কারণ না হয়।