পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়
আজও আমাদের দেশের এখানে ওখানে সমাজের মধ্যে, রাজনৈতিক ভাবে ধর্মের আধিপত্য বিস্তার করে রয়েছে সমস্ত স্তরে বিভিন্নভাবে। যার পরিণতিতে মানুষের দ্বারা মানুষ খুন হয়,মানুষের দ্বারা লুন্ঠিত হয় নারীর সম্ভ্রম, ইজ্জত,মানুষের দ্বারা আগুনে পুড়ে ছারখার হয়ে যায় মানুষেরই ঘরদোর।মানুষের দ্বারা অত্যাচারিত মানুষ। শুধুমাত্র ধর্মের দোহাই দিয়ে।
আজকের এই অবস্থায়,মনে হয় অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক আজ থেকে ১০০ বছর আগে কাজী নজরুল ইসলাম যে কাব্য,গান সৃষ্টি করে গেছেন,তা যেন আজও প্রাসঙ্গিক হয়ে আমাদের সামনে প্রতিভাত হয়ে উঠছে। কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর “মন্দির মসজিদ ” নামের প্রবন্ধে লিখেছিলেন –” ধর্ম-লড়াইয়ে রক্তাক্ত মানুষ কোনও দিন আশ্রয় পায়নি মন্দির মসজিদের দালানে। যন্ত্রনা কাতর মানুষকে রাস্তায় ফেলে কেটে পড়েছে ধর্মের পাহারাদারেরা। নজরুল তাঁর “রাজবন্দীর জবানবন্দী”-তে দ্ব্যর্থহীনভাবে সুতীব্র ধারালো ভাষায় লিখেছেন–” রাজার পক্ষ যাঁরা নেন,তাঁদের লক্ষ্য স্বার্থ, আর মানবতার পক্ষ যাঁরা নেন, তাঁদের লক্ষ্য সত্য।”
কাজী নজরুল ইসলামের ধর্মচেতনা নিয়ে আলোচনায় আমরা দেখতে পাই,নজরুলের “আমার ধর্ম” নামক প্রবন্ধে তুনি লিখছেন, জিজ্ঞাসা করছেন–“কিসের ধর্ম? আমার বাঁচাই আমার ধর্ম। দু’বেলা দুটি খাবার জন্যই যার বাঁচা তার আবার ধর্ম কি?”
এই সত্যকে জানলে চিনলে,বুঝলে, নিজের ধর্মকে চেনা যায়,জানা যায়,বোঝা যায়।আর অন্যের ধর্মের প্রতি দরদী,মরমী হওয়া যায়।
কাজী নজরুল ইসলাম মানবতাবাদী,সমন্বয়বাদী।বিদ্রোহ নজরুলের ভাষায়,কাব্যে গানে। তাই জাতপাতের সাম্প্রদায়িক মনোভাবের বিরুদ্ধে লিখছেন.–” হিন্দু না ওরা মুসলিম ঐ জিজ্ঞাসে কোন জন?/ কান্ডারী! বলো ডুবিছে মানুষ সন্তান মোর মা’-র।”
কাজী নজরুল ইসলাম অসাম্প্রদায়িক কবি সারা বিশ্বে।তাই তিনি লিখতে পারেন–“কালো মেয়ের পায়ের তলায় দেখে যা আলোর নাচন,/ রূপ দেখে শিব,বুক পেতে দেয় যাঁর হাতে মরন বাঁচন..”। আবার তিনি লিখছেন -” আমি কী সুখে লো গৃহে রব,/ আমার শ্যাম যদি ওগো হোল যোগী”। পাশাপাশি নজরুল লিখছেন–” রমজানের ওই রোজার শেষে এলো খুশীর ঈদ রে “। কিম্বা,” মোহম্মদ নাম জপমালা..”।
এরই সাথে আমরা জানি সেই সময়ের আমাদের দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিপ্লবীদের কাছে কাজী নজরুলের গান, কবিতা,ছিল এক ঐতিহাসিক ঐতিহ্য পূর্ণ অনুপ্রেরণা। যেমন,”কারার ওই লৌহকপাট ভেঙ্গে ফেল কর রে লোপাট, রক্ত জমাট শিকল পুজার পাষাণবেদী..”। বা “জাতের নামে বজ্জাতি সব জাত জালিয়াত খেলছো জুয়া..”।
সেই সময়ে কাজী নজরুল সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বাতাবরন সৃষ্টি করতে একের পর এক পত্র পত্রিকা সম্পাদনা করেছিলেন এক নতুন যুগের দৃষ্টিভঙ্গীতে।যথা– নবযুগ, ধুমকেতু, লাঙল, জাতীয়তাবাদী মোসলেম পত্রিকা,ইত্যাদি।
নজরুলকে আমাদের তখনকার সমাজের এক অংশ বলতো হিন্দু ভজা,আরেক অংশ বলতো মুসলমান ভজা।
আসলে নজরুল ছিলেন এসবের উর্ধ্বে।
তাই নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু বলেছিলেন -” কাজী নজরুল ইসলাম একজন সম্পূর্ণ জীবন্ত মানুষ “।
রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন– “আয়রে ধুমকেতু..”।
সেই নজরুল একদিন ” দেখিয়া শুনিয়া ক্ষেপিয়া গিয়াছি..” বলে হয়ে গেলেন হতবাক,বাকরুদ্ধ।
তারপর সে এক অন্য ইতিহাস। ধর্মের দোহাই দিয়ে অখন্ড ভারতবর্ষ হোল ভাগ।ভাগ হোল বাংলা।লক্ষ লক্ষ মানুষের রক্তে,কান্নায় লেখা হোল দেশভাগের মানচিত্র।লেখা হোল অনুকম্পার ইতিহাস।খুন,ধর্ষনের ইতিহাস। ভাগ হয়ে গেল প্রতিবেশী, ভাগ হয়ে গেল ভিটেমাটি।ভাগ হয়ে গেল অনেক অনেক কিছু। মুখোমুখি অবাক চোখের চাউনিতে রাতের শিশিরের,শবনমের একফোঁটা, কিম্বা এক বিন্দু বিষ্টির জল সীমান্তের কাঁটাতারের বেড়ায়…অমোঘ নিয়মে যখিন তারা সীমান্তের এপারে ওপারে মাটির বুকে ঝরে পড়ল..তখন তাদের নামকরণ হোল–একদিকে জল,আরেক দিকে পানি।
কিন্তু নজরুল ভাগ হননি।নজরুল ভাগ হন না।তাই যতদিন রাষ্ট্র,যুদ্ধ,রক্ত,ধ্বংস, থাকবে,যতদিন থাকবে শোষণ, উৎপীড়ন, অবিচার, অত্যাচার দরিদ্র অসহায় মানুষের ওপরে,ততদিন “বিদ্রোহী রণক্লান্ত” সেই অশান্ত কাজী নজরুল ইসলামও থাকবেন মানুষের মধ্যে অবিস্মরণীয়।
তাই নজরুলের সেই অব্যর্থ প্রাসঙ্গিকতায় আজও ভোরের আজানের সাথে মিশে যায়,মঙ্গল শঙ্খধ্বনির আবাহনীর আহ্বান। মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় উস্তাদ বিসমিল্লা খানের সানাইয়ের করুন সুরের সাথে পন্ডিত ভীমসেন যোশীর সূর্যোদয়ের রাগে ভোরের ভৈরবীর কোমল রেকবের স্বরগম।
যুগলবন্দীতে প্রাঞ্জল হয়ে ওঠে পন্ডিত রবিশঙ্করের সেতারের মূর্ছনায় যখন একাকার হয়ে যায় উস্তাদ আলী আকবরের সরোদের সুরবাহার গোধুলীয়া সন্ধ্যার রাগে সাঁঝের ইমনের কড়ি মধ্যমের আলিঙ্গনে।
তাই নজরুল চিরায়ত হয়ে থাকেন আমন্ত্রণে-দাওয়াতে,নজরুল আত্মার আত্মীয় হয়ে থাকেন বাংলার মা আর আম্মিজানে,বাবা আর বাপজানে,ভাই আর ভাইজানে। নজরুল প্রাসঙ্গিক হয়ে থাকেন সকালের আজান আর পুজার ঘন্টার মিলিত হরষের মুহুর্তে। নজরুলের উজ্জ্বল উপস্থিতি আমরা অনুভব করি সন্ধ্যায় তুলসীতলায় প্রদীপের আলোয়,আর পবিত্র দরগার সাঁঝের বাতির আলোয় আলোয়।
অনন্যতার এক নাম কাজী নজরুল ইসলাম। রাম-রহিমের সুখেদুখে, হাসিকান্নায়, ঘরকন্নায়, ঘাম ঝরানো পরিশ্রমে খেতে খামারে,কলে- কারখানায়,দিন আনা দিন খাওয়া আটপৌরে আমাদের প্রত্যহিক ব্যবহারিক জীবনে তাই পরম্পরাগতভাবে কাজী নজরুল ইসলামের প্রাসঙ্গিকতা আজও রয়ে গেছে।
নজরুল ইসলাম আমাদের সংস্কৃতি, আমাদের ভরসা,বিশ্বাস।কাজী নজরুল ইসলাম আমাদের আল্লাহ ভগবান।
নজরুল তাই আমাদের ভিতর বাহিরে,অন্তরে অন্তরে,সীমান্ত রেখায়,বিভেদের মাঝে অভিন্নতায় চিরদিন শাশ্বত সূর্য হয়ে ছিলেন,আছেন এবং থাকবেনও।
সকলের সম্প্রীতি আর মহান অনুভবের পিলসুজে অনির্বান শিখায় জ্বলুক “কাজী নজরুল ইসলাম ” নামের প্রদীপখানি।
তবেই আমাদের সার্থকতা।