প্রথম পাতা প্রবন্ধ আসুন, একটি সংক্ষিপ্ত উপপাদ্য, একটু পড়ে দেখি…

আসুন, একটি সংক্ষিপ্ত উপপাদ্য, একটু পড়ে দেখি…

457 views
A+A-
Reset

পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়

আজ এক মহাসন্ধিক্ষণের মধ্যে দিয়ে আমরা আমাদের পথ অতিক্রম করছি। সযত্নে বুকে করে আগলে রাখতে হবে আমাদের দেশের “বিবিধের মাঝে মিলন মহান”-এর ঐতিহাসিক ঐকতানের সংস্কৃতিকে। আজ এই পূণ্য পবিত্র দিনে আসুন এই সংক্ষিপ্ত অথচ প্রাসঙ্গিক উপপাদ্যটি একটু পড়ে নিয়ে আমাদের প্রণাম জানাই আমাদের জন্মভূমিকে, আমাদের মাতৃভুমিকে।

আমাদের দেশের সামাজিক পরম্পরার মূল ভিত্তিই হলো সহিষ্ণুতা, সংবেদনশীলতা, সহমর্মিতা, ইত্যাদির এক মহতী আবহমান আবহ।যার মধ্যেই আমাদের জীবনের যাবতীয় নিষিক্ত হয়ে আছে।আমাদের বসবাস, আমাদের এগিয়ে যাওয়া। আমাদের পারস্পরিক ভালোবাসা, দায়বদ্ধতা।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর “মুসলমানী”-নামক ছোটগল্পে হারিয়ে যাওয়া,নিজ সমাজচ্যুত একটি কিশোরীর চরিত্রের মুখ দিয়ে বলছেন– “একটা কথা মনে রেখো,–যারা যথার্থ মুসলমান, তারা ধর্মনিষ্ঠ হিন্দুকে সম্মান করে,আর যারা যথার্থ হিন্দু,তারাও মুসলমানদের সম্মান করে। আমার ঘরে তুমি হিন্দু বাড়ির মেয়ের মতোই থাকবে।অন্যথা হবে না।আমার নাম হবির খাঁ। আমার বাড়ি খুব নিকটে, তুমি চলো মা,তোমাকে আমি খুব নিরাপদেই রেখে দেবো মা…।”

আবার আমরা পাই আর এক জায়গায়,যেখানে রবীন্দ্রনাথ তাঁর “গোরা” উপন্যাসের নায়ক চরিত্র গোরা-র সংলাপে বলছেন–“আপনি আমাকে আজ সেই দেবতারাই মন্ত্র দিন,যিনি হিন্দু-মুসলমান, খৃষ্টান,শিখ,ব্রাহ্ম,সকলেরই। যার মন্দিরের দ্বার কোনো জাতির কাছে,কোনো ব্যক্তির কাছে কোনোদিনও অবরুদ্ধ হয়না।”

শুধু কি রবীন্দ্রনাথ? আরও আগে ভারতবর্ষকে যিনি পায়ে হেঁটে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে চিনেছিলেন, জেনেছিলেন ভারতের আত্মাকে,ভারতের সাধারণ মানুষকে উত্তরে কাশ্মীর থেকে দক্ষিণে কন্যাকুমারিকা,পূবে অবিভক্ত বাংলা থেকে পশ্চিমে রাজস্থান..–সেই স্বামী বিবেকানন্দ,যিনি বলেছিলেন আমেরিকায় চিকাগো ধর্মমহাসম্মেলনে– “…hinduism is not a religion, it is the world’s ancient civilization, and mother of all religions… ” সেই স্বামী বিবেকানন্দই আবার পবিত্র কুরআন-এর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বলছেন– “..এমন বিজ্ঞান বা শিল্প নেই,যা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কুরআন বা হাদীসের বহুবাক্যের দ্বারা অনুমোদিত এবং উৎসাহিত নয়।”(প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য /স্বামী বিবেকানন্দ / পৃ-১১৭)

ইউরোপ ভ্রমনের সময়ে স্বামী বিবেকানন্দ বলছেন একটি ভাষনে–” আমাদের মাতৃভুমির পক্ষে হিন্দু ও ইসলাম ধর্মরূপ এই দুই মহান মতের সমন্বয়ই একমাত্র আশা।…আমি দিব্যচক্ষে দেখিতেছি যে, বৈদান্তিক মস্তিষ্ক এবং ইসলামি দেহ লইয়া ভবিষ্যতে ভারত গৌরবান্বিত হইয়া উঠিবে।(লন্ডনে বিবেকানন্দ/মহেন্দ্রনাথ দত্ত/ পৃ-১৪৭-৪৮/ মহেন্দ্রনাথ ছিলেন স্বামী বিবেকানন্দের মেজভাই)।

আমাদের লৌকিক, ব্যবহারিক জীবনে থাকুক সেই ধর্ম, যে ধর্মের বিকাশের ভবিষ্যৎ বানী করে আহ্বান জানিয়েছেন ভারতের নবজাগরণ পুনর্জাগরণের পুরোধা স্বামী বিবেকানন্দ — “নতুন ভারত বেরুক।বেরুক লাঙল ধরে,চাষার কুটির ভেদ করে,জেলে-জোলা-মালা-মুচি-মেথরের ঝুপড়ির মধ্য হতে।বেরুক মুদিওয়ালার দোকান থেকে, ভুনাওয়ালার উনুনের পাশ থেকে। বেরুক কারখানা থেকে,হাট থেকে,বাজার থেকে।”
স্বামী বিবেকানন্দই ভারতবর্ষকে দেখালেন কাশ্মীরে এক মুসলমান কন্যাকে দেবী দুর্গার প্রতিরূপে কুমারী পুজোর নিবেদনে। তিনিই এই সংস্কারাচ্ছন্ন ভারতবর্ষকে দেখালেন এক ঐতিহাসিক ঘটনার বাস্তবরূপ।

স্বামী বিবেকানন্দই রিচনা করেছিলেন এক ঐতিহাসিক ঘটনার ইতিবৃত্ত। সেটি হলো–
কলকাতার বাগবাজারের ১৭ নং বোসপাড়া লেনের বাড়িতে আজ থেকে ১৫০ বছর আগের এই বাংলার বাঁকুড়ার জয়রামবাটির এক গ্রাম্য নারী,যিনি কামারপুকুরের গ্রাম্যবধুমাতা,সেই শ্রীমা সারদা,ইউরোপ থেকে আগত মিস এলিজাবেথ মার্গারেট নোবেল(পরে ভগিনী নিবেদিতা),নরওয়ের মিসেস সারা ওলি বুল,আমেরিকার জোসেফাইন ম্যাকলাউড প্রমুখদের নিয়ে এক থালায় খাচ্ছেন মুড়ি,বাতাসা,নারকেল নাড়ু। না সেখানে কোন জাত নেই,নেই কোন ধর্মের সীমারেখার গন্ডী..আছে শুধু মানুষের প্রতি ঈশ্বরজ্ঞানে মানুষের ভালোবাসা। সাক্ষী ছিলেন আড়াল থেকে স্বামী বিবেকানন্দ আর শরৎ মহারাজ(স্বামী সারদানন্দ)।

এই মন্ত্রই ছিল নেতাজী সুভাষচন্দ্রের অন্তরের হৃদ-মাঝারে। তাই তিনি একক-ব্যক্তিকেন্দ্রিক “আমি”-থেকে তার গন্ডী পেরিয়ে অনেক অনেক বড়ো ” আমি”-র উত্তরনের পথে শপথ নিয়েছিলেন -তাঁর মন্ত্রদীক্ষাদাতা স্বামী বিবেকানন্দের আদর্শের অনুসৃত পথে।
আমরা জানি ইতিহাসে সেই সম্প্রীতির কথা, যা উচ্চারিত হয়েছিল একদিন এদেশে তথাগত বুদ্ধ থেকে শ্রীচৈতন্য, সন্ত কবীর থেকে মীরাবাঈ,গুরু নানক, হয়ে সন্ত সত্য সাঁই,নিজামুদ্দিন আউলিয়া,লালন ফকির,সিরাজ সাঁই,চন্ডীদাস,সন্ত থিরুমল,প্রমুখদের মুখ-নিঃসৃত বানী হয়ে,সেই কথাই আমরা শুনি নেতাজীর ১৯৪৪ সালের নভেম্ভরে টোকিও ইম্পিরিয়াল ইউনিভার্সিটিতে প্রদত্ত ভাষনে–“..ভারতবর্ষের মুক্তি আন্দোলনে এবং আজাদ হিন্দ ফৌজের মধ্যে জাতি,ধর্ম,বা শ্রেনীর কোনও প্রাধান্য নেই। রাষ্ট্র কখনোই ধর্মীয় মতবাদের ওপরে চালিত হতে পারেনা। ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা হল মানুষে মানুষে বিভাজনের বিষ–তাকে আমাদের স্বাধীন ভারতবর্ষে অঙ্কুরেই বিনাশ করতে হবে। রাষ্ট্র পরিচালনায় কোনও রকমের জাত-পাত-ধর্মের প্রাধান্য দেওয়া যাবেনা। তাহলেই আমাদের মাতৃভূমির যে ঐক্যের ঐতিহ্য,ইতিহাস,তা ক্ষুন্ন হবে,অচিরেই ভেঙে পড়বে। আর প্রতি মুহূর্তেই জন্ম নেবে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বিচ্ছিন্নতাবাদ।”

১৯৩৩ সালের ৬ই ফেব্রুয়ারী তারিখে শ্রীনিকেতন-এ রবীন্দ্রনাথ একটি সভাতে বলেছিলেন–“…আজ সময় এসেছে মিলবার।ভগবানের আকাশের দিকে চেয়ে পরস্পর পরস্পরকে বুকে তুলে নিতে হবে।পুরানো শাস্ত্র ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন ধর্মের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকার দিন চলে গেছে। সেই বিশ্বমৈত্রীর পথেই ধর্মবোধ সুন্দর করুক সভ্যতা।”

আজাদ হিন্দ ফৌজের উচ্চপদস্থ অফিসার ছিলেন মেজর আবিদ হাসান সাফরানি।তিনি তাঁর “স্মৃতিকথা”-য় লিখছেন– “আজাদ হিন্দ ফৌজের সেনারা পরস্পরের প্রতি সম্বোধনের সময়ে চিরাচরিত প্রথাই অনুসরন করতেন। মুসলিমরা পরস্পরকে ‘আস্ সালাম্ ওয়ালেকুম্’, শিখ-পাঞ্জাবীরা ‘সৎ শ্বী আকাল’, হিন্দুরা ‘নমস্তে জি,বা নমস্কার’, দক্ষিন ভারতীয়রা ‘নমস্কারম্’,
রাজপুতরা,বিহারের, উত্তরপ্রদেশীরা ‘জয় রাম-জী কি’–এটাই ছিল সাধারণত ভাষা। নেতাজীর ভাবনায় আমরা ভাবলাম, তাহলে ‘হিন্দুস্তান’কোথায়? আমরা ‘জয় হিন্দুস্তান ‘ বললেই তো হয়। সেই থেকেই বেরিয়ে এলো –‘জয় হিন্দ’।”

এই একই বিবরণ পাওয়া যায় সামরিক গোয়েন্দা দপ্তরের Mr.H.Toye-র লেখা “The springing Tiger” বই থেকে।

আর একটি ইতিহাস আমাদের আজ জানা দরকার।১৯৪৩ সালের ২১ শে অক্টোবর। নেতাজীর নেতৃত্বে আজাদ হিন্দ সরকার গঠন করা হয়েছে। ভারতবর্ষ সহ সারা পৃথিবী জুড়ে এক রোমাঞ্চকর ঘটনা ঘটে গেছে।ব্রিটিশ হতভম্ব হয়ে গেছে। সেই আনন্দেই বিভিন্ন দেশে নেতাজীর আকর্ষণ আকাশচুম্বী। সবাই তাঁকে সম্বর্ধনা দিতে চাইছে,সম্মানিত করতে চাইছে।

সিঙ্গাপুরে চেট্টিয়ার সম্প্রদায়ের বিখ্যাত মন্দির রয়েছে।সেখানে সেই মন্দির কর্তৃপক্ষ নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুকে সেই মন্দিরে সম্বর্ধনা দেওয়ার বিশেষ আমন্ত্রণ জানালেন। এই চেট্টিয়ার সম্প্রদায় ছিল কট্টর হিন্দু। নেতাজী মন্দির কর্তৃপক্ষকে জানালেন যে আজাদ হিন্দ সরকারের মন্ত্রীসভায় হিন্দু,মুসলমান, শিখ,খ্রীশ্চান,বৌদ্ধ, জৈন,সব সম্প্রদায়ের মানুষ আছেন।সুতরাং তাদের সকলকে নিয়েই তিনি মন্দিরে সম্বর্ধনা নিতে যাবেন। প্রথমে সেই গোঁড়া হিন্দু চেট্টিয়ার সম্প্রদায় আপত্তি করেছিল,কিন্তু নেতাজীর অনমনীয় বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্বের কাছে তারা নতি স্বীকার করে তাদের মত বদল করেছিল। সেদিন ভারতবর্ষের ইতিহাসে সর্বধর্মসমন্বয়ের এক ঐতিহাসিক ভুমিকা প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু।

এই হোল আমাদের ভারতবর্ষের ইতিহাস।এই হোল আমাদের ভারতবর্ষের ঐতিহ্য।
আসুন,আমাদের শুভবোধ জাগ্রত হোক।মানুষের ঐকান্তিক সভ্যতা আবার মানবিক গুণাবলির অধিকারে প্রতিষ্ঠিত হোক। আর সেই লক্ষ্যেই আমাদের ঘরে রাম থাকুক,রহিমও থাকুক। আল্লারাখা থাকুক,রাখোহরিও থাকুক।সত্যনারায়ন-সত্যপীরের পাঁচালীতেই থাকুক আমাদের ভারতবর্ষের প্রতিটি মানুষের জীবন পথের প্রাত্যহিক ভালোবাসার মরমী দরদী পাঁচালী।আমাদের ভালোবাসার প্রদীপ জ্বলুক নিত্যদিন মন্দিরে,মসজদে,গুরুদ্বারে,
গীর্জায়,…আমাদের অন্তরে অন্তরে।
এই স্বপ্নই তো দেখেছিলেন নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু।

আজ রইল সেই অঙ্গীকার, নেতাজীর শুভ আবির্ভাবের দিনে।
প্রণাম নেতাজী।
জয়তু নেতাজী।
জয় হিন্দ। বন্দেমাতরম।
ইনকিলাব জিন্দাবাদ।

আরও খবর

মন্তব্য করুন

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

সম্পাদকের পছন্দ

টাটকা খবর

©2023 newsonly24. All rights reserved.