প্রথম পাতা প্রবন্ধ “সাধনা ঔষধালয় ঢাকা”… অধ্যক্ষ যোগেশচন্দ্র ঘোষ এবং এক মর্মান্তিক ইতিহাস

“সাধনা ঔষধালয় ঢাকা”… অধ্যক্ষ যোগেশচন্দ্র ঘোষ এবং এক মর্মান্তিক ইতিহাস

247 views
A+A-
Reset

পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়

এপার বাংলা ওপার বাংলা.. দুই বাংলাতেই পথচলতি মানুষ রাস্তার বিভিন্ন জায়গাতে বিভিন্ন সময়ে দেখেছেন বড় বড় হোর্ডিং… তাতে লেখা থাকতো “সাধনা ঔষধালয় ঢাকা” এবং তার পাশেই থাকতো একটি ছবি, নীচে লেখা থাকতো “অধ্যক্ষ যোগেশচন্দ্র ঘোষ”।

প্রাচীন ভারতবর্ষের আয়ুর্বেদ শাস্ত্রের নাম ডাক ছিল সারা পৃথিবী জুড়ে। কারণ আমরা জানি যে ৪০০০ খ্রিস্টপূর্ব সময়ে এই ভারতবর্ষ সারা বিশ্বকে পথ দেখিয়েছিল অস্ত্রোপচার, আয়ুর্বেদিক নানারকমের ওষুধপত্র এবং চিকিৎসা পদ্ধতির। আর এই বিষয়ে অগ্রগন্য ছিলেন ঋষি চরক…যাঁর লেখা গ্রন্থ ” চরক সংহিতা”। নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কিছু আয়ুর্বেদ গ্রন্থ চৈনিক পর্যটক হিউয়েং সাং যাবার সময়ে চিনে নিয়ে চলে যান। পরে আলাউদ্দিন খলজি যখন নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় পুড়িয়ে দেয়,তখন আয়ুর্বেদ শাস্ত্রের প্রায় ৫০০০ বই সব পুড়ে ছাই হয়ে যায়। এই ইতিহাস সকলেই আমরা জানি। সেই আয়ুর্বেদ শাস্ত্র ছিল সম্পুর্ণ রসায়ন শাস্ত্র ভিত্তিক দেশীয় ভেষজ দ্বারা ওষুধ তৈরীর পদ্ধতি প্রণালী।

আধুনিক বিশ্বে এর প্রসার এবং প্রচার পরবর্তী সময়ে প্রচুর পরিমাণে বৃদ্ধি পায়। আর এই বিষয়ে সারা দুনিয়ায় অন্যতম পথিকৃৎ হলেন বিজ্ঞানী অধ্যক্ষ যোগেশচন্দ্র ঘোষ।

তিনি ১৮৮৭ সালের ১১ জুন অবিভক্ত বাংলার অন্যতম প্রাচীন নগরী ঢাকা শহরের শরিয়তপুরের গোসাঁইয়ের হাট নামক একটি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। বাবার নাম ছিল পূর্ণচন্দ্র ঘোষ এবং মায়ের নাম ছিল সাধনাবালা দেবী।
যোগেশচন্দ্র প্রথমে ঢাকার কে.এল. জুবিলি স্কুলে পড়াশোনা শুরু করেন,তারপর ঢাকার জগন্নাথ কলেজে, এরপর কুচবিহারের কলেজের থেকে স্নাতক হয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসেন।রসায়ন শাস্ত্র নিয়ে পড়াশোনার সময়ে তিনি অন্যতম মাস্টারমশাই হিসাবে পেয়েছিলেন বিজ্ঞানী আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের সান্নিধ্য অতি অন্তরঙ্গভাবে।বলা যায় বিজ্ঞানী প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের কথাতেই যোগেশ্চন্দ্র দেশীয় ভেষজ উপাদান দিয়ে ওষুধ তৈরি করার প্রস্তুতিতেই ১৯১৪ সালে ঢাকার গেণ্ডারিয়ায় ৭১ নম্বর দীননাথ সেন রোডে কয়েক একর জমিতে প্রতিষ্ঠা করেন আয়ুর্বেদিক ওষুধের কারখানা, যার নাম…”সাধনা ঔষধালয়, ঢাকা..”।

বাঙালির দ্বারা বাণিজ্য বা ব্যবসা হয়না..এই আপ্তবাক্যটিকে সম্পূর্ণ ভুল প্রমানিত করে যোগেশচন্দ্র ধীরে ধীরে তার আয়ুর্বেদ ওষুধের ব্যবসাকে দেশ থেকে বিদেশে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। বাঙালির অন্যতম এক ব্যবসার প্রতিষ্ঠান হিসাবে সাধনা ঔষধালয়,ঢাকার নাম ও খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে দিকে দিকে। এর পাশাপাশি তিনি প্রথমে বিহারের ভাগলপুর কলেজে অধ্যাপনা করেন এবং তারপরে ঢাকার জগন্নাথ কলেজে অধ্যক্ষ হিসাবেও কাজ করেছিলেন। তিনি আয়ুর্বেদ শাস্ত্রের ওপরে অনেক গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। ইংরেজি ও বাংলা দুই ভাষাতেই। সেসব বই আজও পাওয়া যায়।

যোগেশচন্দ্র ছিলেন আদ্যোপান্ত একজন অতি সৎ, অতি সজ্জন, মানবদরদী এক অসাম্প্রদায়িক মানসিকতার মানুষ।

১৯৪৭ সালে দেশভাগের আগে ১৯৪৬ সালে সারা ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গাতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছিল হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে। এবং তা ছড়িয়ে পড়েছিল দিকে দিকে।এই বাংলাতেও সেই দাঙ্গার আগুন জ্বলে উঠেছিল বিভিন্ন স্থানে। সেই সময়ে এবং পরবর্তী সময়ে,১৯৪৭-৪৮ সালে,১৯৬৪-৬৫ সালে সেই দাঙ্গায় আক্রান্ত ঢাকা এবং আশেপাশের এলাকায় থাকা হিন্দুদের এমনকি মুসলমানদেরও তিনি তার সেই বিশাল কারখানার দরজা খুলে দিতেন এবং আক্রান্তদের আশ্রয়, খাবার সবকিছুর বন্দোবস্ত করতেন। আর গেটে সারাক্ষণ থাকতো বন্দুক হাতে প্রহরীরা পাহারায়। তিনি সকলকে শান্তি সম্প্রীতির কথা বলতেন।

তার ব্যবসায়,কারখানায় কাজ করতো হিন্দু,মুসলমান, শিখ-সহ বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ জন। তিনি শিক্ষায়,সমাজসেবায়, চিকিৎসা ব্যবস্থায় অনেক দান করেছিলেন। প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বিদ্যালয়, মাদ্রাসা, হাসপাতাল, গরীব ছাত্রদের জন্য ছাত্রাবাস, দুঃস্থদের জন্য বিভিন্নরকম সমাজসেবামূলক কাজ তিনি করেছিলেন। তাই সেই সময়ে এক ডাকে যোগেশচন্দ্রকে সমস্ত সম্প্রদায়ের মানুষ মসীহারূপে,আপনজন রূপে সম্মান করতো।

যাইহোক, দেশভাগের পরে যখন দিন দিন সাম্প্রদায়িক অস্থিরতা বাড়তে লাগলো, যখন ওপার বাংলা থেকে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষজন এপার বাংলাতে চলে আসতে লাগলো, তখন অনেকেই যোগেশচন্দ্রকে ঢাকা ছেড়ে ভারতে চলে আসার কথা বলেছিলেন,তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ডাক্তার বিধান চন্দ্র রায়,বিজ্ঞানী মেঘনাথ সাহা, বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু, জ্যোতি বসু,কমিউনিস্ট পারটির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা মুজফফর আহমেদ, বিজ্ঞানী জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ,ডঃহীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, প্রফুল্লচন্দ্র সেন,অতুল্য ঘোষ,দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের স্ত্রী বাসন্তী দেবী,কবি গোলাম মোস্তাফা, সেই সময়ের পশ্চিম বঙ্গের রাজ্যপাল ডঃ হরেন্দ্র কুমার মুখোপাধ্যায়, কবি শামসুল হক, কবি শামসুর রহমান,কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়, কবি বুদ্ধদেব বসু, কবি নরেন্দ্র দেব,(নবনীতা দেবসেনের বাব),৷ সাহিত্যিক রাধারানী দেবী,মহাশ্বেতা দেবী,চিত্রতারকা কানন দেবী,তখনকার উদীয়মান নায়িকা সুচিত্রা সেন,শিল্পী দেবব্রত বিশ্বাস, চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায়,ঋত্বিক ঘটক,সাহিত্যিক সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায় (শিল্পী সুচিত্রা মিত্রের বাবা),সাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়,মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, বনফুল, প্রমুখ প্রমুখ সহ তার আত্নীয়স্বজন,প্রতিবেশী, বন্ধুবান্ধব সকলেই।

কিন্তু যোগেশচন্দ্র ঘোষ-এর একটাই উত্তর ছিল.. “এইখানে আমার জন্ম,কর্ম, এই মাটিতেই আমি মরতে চাই।আর এখানে সকলেই আমার আপনজন, অতএব আমি এখান থেকে কোথাও যাবো না।”

এইভাবেই দিন যায়,মাস যায়,বছর যায়।তারপর এলো সেই অভিশপ্ত সময়কাল… ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ।
যেদিন পাকিস্তানের হানাদার বাহিনী নৃশংসভাবে ঝাপিয়ে পড়লো সেই সময়কার পূর্ব বাংলার মাটিতে।শুরু হলো অকথ্য অত্যাচার,খুন,ধর্ষন,বাড়িতে আগুন লাগানো ইত্যাদি ইত্যাদি দুনিয়া কাঁপানো এক হিংস্র অস্থিরতা। বিশেষ করে পাকিস্তান বিরোধী হিন্দু-মুসলিম বাঙালীদের ওপরে আক্রমণ নেমে এলো চরমভাবে।পাক হানাদার বাহিনীকে সাহায্য করতে লাগলো মুসলিম সম্প্রদায়ের পাকিস্তানপন্থী রাজাকার বাহিনী, আলবদর -আলশামসের বাহিনী। নির্বিচারে শুরু হয়েছিল গণহত্যা, গণধর্ষণ। হিন্দু সম্প্রদায়ের বাঙালীকে “ভারতের দালাল” বলে তাদের ওপরে চালাতে লাগলো প্রচন্ডভাবে আক্রমণ। সমস্তটাই ছিল পরিকল্পনা মাফিক।তাই প্রানের দায়ে দল বেঁধে মানুষ এপার বাংলায় পালিয়ে আসতে শুরু করলো। সেই সময়েও যোগেশচন্দ্রকে এপারে চলে আসার কথা বলা হয়েছিল,কিন্তু তিনি যথারীতি সে কথা না শুনে ঢাকাতেই থেকে গিয়েছিলেন,বলেছিলেন আমার এইসব আপন ভাই বেরাদরদের ছেড়ে আমি কোথায় যাব? আমি এখানেই থাকবো এদের নিয়েই,এরাই আমার আপনজন।

তিনি রয়েই গেলেন তার জন্মভূমিতে। আশৈশব,আজীবন যেখানে ছিল তার কর্মময় জীবনের ইতিহাস।

এরপর এলো সেই কালো রাত। ১৯৭১ সালের ৩রা এপ্রিলের মধ্যরাতের তৃতীয় প্রহর। কারখানার গেটে সেদিন পাহারায় ছিলেন ইউসুফ মিয়া,রাম পাল, সুকুর আলি মিয়া,ডোমি সিং প্রমুখ বন্দুকধারীরা। গেটের সামনে এসে দাঁড়ালো পাক হানাদারদের সাঁজোয়া গাড়ি। গেট খুলতে বলল।কিন্তু গেট খুলল না ইউসুফ,রাম পাল,সুকুর মিয়া,ডোমি সিং-রা।শুরু হলো গুলি বিনিময়। শেষে পাক হানাদারদের গুলিতে খুলে গেল গেটের তালা। ঠিক সেই সময়ে পাশেই থাকা মসজিদ থেকে ভোরের আজান শুরু হয়েছিল। বেশ কিছু মানুষ বেড়িয়ে এসেছিল।পালিয়ে গিয়েছিল পাক হানাদারেরা।

পরেরদিন ৪ঠা এপ্রিল, সকাল বেলা। আগের দিনের শেষরাতের ঘটনার ব্যাপারে বাড়ি থেকে নীচে নেমে এসে যোগেশচন্দ্র কারখানার সকলের সাথে সুরক্ষার বিষয় ,পরবর্তী কী করনীয় সেই বিষয়,ইত্যাদি ইত্যাদি সমস্ত ব্যাপারে আলোচনা করছিলেন। ঠিক সেই সময়েই বিরাট বাহিনী নিয়ে এলো পাক হানাদার বাহিনী, সাথে রাজাকার আর আলবদরের পাকিস্তান পন্থী মুসলিম বাঙালিরা। ভেঙে ফেলেছিল কারখানার গেট।ভেতরে ঢুকে কারখানার সকলকে নীচে একটা জায়গাতে দাঁড় করিয়ে বেঁধে রেখে,সেই সময়ে ৮৪ বছরের বৃদ্ধ মানুষ যোগেশচন্দ্র-কে নিয়ে কারখানার লাগোয়া বাড়ির ওপরে নিয়ে গিয়েছিল। অনেকক্ষন পরে শোনা গিয়েছিল পরপর আকাশ বাতাস কাঁপানো,কান ফাটানো গুলির আওয়াজ, অকথ্য ভাষার গালাগালি,সিন্দুক ভাঙার আওয়াজ, ইত্যাদি ইত্যাদি।

পরে জানা যায় পাকিস্তানের হানাদার বাহিনী আর রাজাকারদের মুসলিমরা প্রবীণ যোগেশচন্দ্রের সারা জীবনের যাবতীয় সম্পদ সিন্দুক ভেঙে বাক্স ভর্তি করে নিয়ে গিয়েছিল,আর বিজ্ঞানী যোগেশচন্দ্রকে প্রথমে বেয়নেট দিয়ে তার পাঁজরে,পিঠে,বুকে,খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে খুন করে,এবং শেষে তিনি উপুড় হয়ে মাটিতে পড়ে গেলে তাঁকে একাধিকবার গুলি করে পাকিস্তানের হানাদার বাহিনী আর রাজাকারদের পাকিস্তানপন্থী মুসলিম বাঙালিরা।

এইসব তথ্য পাওয়া গিয়েছিল বাড়ির লাগোয়া পাশের বাড়িতে লুকিয়ে থাকা পাকিস্তান বিরোধী মুক্তিযোদ্ধা এক মুসলিম বাঙালি পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে,আর কারখানার নীচে লুকিয়ে থাকা কয়েকজনের কাছ থেকে।

ভাবলে গায়ে কাঁটা দেয়,কি নৃশংসভাবে একজন বিজ্ঞানী, অধ্যাপক, সজ্জন,সৎ, জনদরদী মানুষকে ধর্মের দোহাই দিয়ে খুন করেছিল সেদিন পাকিস্তানের হানাদার বাহিনী আর রাজাকারদের পাকিস্তানপন্থীরা।

আজও ঢাকাতে সাধনা ঔষধালয় রয়েছে।১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে যোগেশচন্দ্রের ছেলে নরেশ চন্দ্র এবং তার মা, অর্থাৎ যোগেশচন্দ্রের স্ত্রী শ্রীমতী কিরনবালা দেবী আবার প্রতিষ্ঠানটি দাঁড় করান।

বাংলা ও বাঙালির ইতিহাসে অন্যতম এক প্রাচীন প্রতিষ্ঠান এই সাধনা ঔষধালয় ঢাকা। আজ সেই প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠাতা যোগেশপচন্দ্র ঘোষের জন্মদিনে তাঁকে জানাই আমাদের সশ্রদ্ধ ও আন্তরিক প্রনাম। আর ধিক্কার এবং ঘৃনা রইল সেইসব মানুষদের প্রতি যারা ধর্মের নামে,জাত-ধর্ম এবং জাত-পাতের নামে দেখতে মানুষ হয়েও নরাধমের মতো মানুষকে খুন করে,তাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়,সন্ত্রাস তৈরি করে।

বাংলা এবং বাঙালি যতদিন থাকবে,ততদিন থাকবে আয়ুর্বেদ ও রসায়ন বিজ্ঞানী সাধনা ঔষধালয় ঢাকা-র প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ যোগেশচন্দ্র ঘোষের নাম এবং তার সৃষ্টি ও খ্যাতি।

ছবি: উইকিপিডিয়ার সৌজন্যে

আরও খবর

মন্তব্য করুন

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

সম্পাদকের পছন্দ

টাটকা খবর

©2023 newsonly24. All rights reserved.