পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়
উল্লাসকর দত্ত, ১৮৮৫ সালের ১৬ই এপ্রিল অবিভক্ত বাংলার ব্রাহ্মণবেড়িয়া জেলার(এখন বাংলাদেশ) কালীকচ্ছ গ্রামে জন্মগ্রহন করেন। বাবার নাম ছিল দ্বিজদাস দত্ত।তিনি ছিলেন তখনকার সময়ের হাওড়ার শিবপুরে বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের প্রথম ভারতীয় অধ্যক্ষ।
উল্লাসকর কলকাতায় এন্ট্রান্স পাশ করার পরে প্রেসিডেন্সি কলেজে রসায়ন নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেন ১৯০৩ সালে। তিনি পড়াশোনা ছাড়াও সঙ্গীতে,বাঁশি বাজানোতে,তানপুরায়, এবং ব্যঙ্গচিত্র অঙ্কনেও দক্ষ ছিলেন।
প্রেসিডেন্সিতে পড়াকালীন একদিন ক্লাসে ইংরেজ অধ্যাপক ডঃ. রাসেল ভারতীয়দের সম্পর্কে কটুকথা,কটু মন্তব্য করলে উল্লাসকর প্রতিবাদে সাহেবকে জুতো মারেন। পরিনামে পড়াশোনার সেখানেই ইতি। পেছনে লেগে গেল পুলিশ।সেই সময়েই উল্লাসকরের পরিচয় হয় অরবিন্দ ঘোষ, বারীন্দ্র কুমার ঘোষ,প্রমুখদের সাথে। তখন বিপ্লবী দলে নাম লেখান উল্লাসকর। রসায়ন বিজ্ঞানের জ্ঞান কাজে লাগান দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য বোমা বানানোর কাজে।
ক্ষুদিরাম বসু এবং প্রফুল্ল চাকী অত্যাচারী ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ডকে মারার জন্য যে বোমা নিয়ে গিয়েছিলেন,সেগুলি বানিয়েছিলেন এই উল্লাসকর দত্ত।
সে এক ইতিহাস। কিন্তু সেই ঘটনার পরে ব্রিটিশ পুলিশ মুরারীপুকুরের বাগান বাড়ি সহ বিভিন্ন গোপন আস্থানা থেকে ৩৬ জনকে গ্রেফতার করে। বিচারে বারীন ঘোষ,উল্লাসকর দত্তের ফাঁসীর আদেশ হয়।সেই আদেশ শুনে উল্লাসকর কাঠগড়ায় সেদিন দাঁড়িয়েই মনের আনন্দে রবীন্দ্রনাথের “সার্থক জন্ম আমার জন্মেছি এই দেশ সার্থক জন্ম মাগো তোমায় ভালোবেসে” গানটি গেয়েছিলেন।
যাই হোক পরে আপীলে উল্লাসকর, বারীন্দ্রের ফাঁসীর জায়গায় দ্বীপান্তর কারাদন্ড হয় আজীবন। পাঠানো হয় আন্দামানে। সেখানে শুরু হয় অকথ্য, অমানুষিক অত্যাচার। সেই অত্যাচারে উল্লাসকর অর্ধোন্মাদ হয়ে যান। দীর্ঘ চিকিৎসার পরে ১১বছর বাদে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
কলকাতায় এসে পথে পথে ঘুরে শেষে কলকাতার রামমোহন লাইব্রেরির বারান্দার এক কোনে বসবাস করতে থাকেন।ইতিমধ্যে দেশ স্বাধীন হয় ১৯৪৭ সালে।
দেশের সরকার তাকে বিপ্লবী ভাতা দিতে চাইলে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন।কারন স্বাধীনতার জন্য দেশভাগের বিষয়টি তিনি মেনে নিতে পারেননি।
পরে তিনি একটু সুস্থ হয়ে চলে যান দেশের বাড়ি কালীকচ্ছে। সেখানে গ্রামের সেবা করতে থাকেন।
কিছুদিন বাদে উল্লাসকর একবার কলকাতায় আসেন।বেশ কিছুদিন পরে একদিন তিনি জানতে পারেন তাঁর বিপ্লবী মন্ত্রের দীক্ষাগুরু অগ্নিযুগের তিন নেতাদের (বিপিনচন্দ্র পাল,লালা লাজপৎ রায়,বাল গঙ্গাধর তিলক) অন্যতম বিপিনচন্দ্র পালের কন্যা লীলা পাল (যাঁকে উল্লাসকর দত্ত ভালোবাসতেন) বিধবা হয়ে পক্ষাঘাতগ্রস্ত অবস্থায় একটি হাসপাতালে অসহায় অবস্থায় পড়ে আছেন। সেই কথা শুনে তিনি সেখানে যান।তারপর ৬৩ বছরের উল্লাসকর এবং ৬০ বছরের লীলা দেবী পরস্পরকে বিয়ে করেন।এরপর অসুস্থ স্ত্রীকে নিয়ে কিছুদিন ছিলেন সেই রামমোহন লাইব্রেরির বারান্দার এক কোনে। পরে চলে যান টালিগঞ্জ এলাকাতে ভাড়া বাড়িতে। সব শেষে তাঁরা চলে যান আসামের শিলচরে।দুই অসুস্থ মানুষ, সাথে একরাশ দারিদ্র্যতা।
তারপর ১৯৬২ সালে লীলা দেবী মারা যান।আর ১৯৬৫ সালের ১৭ই মে মারা যান ভারতবর্ষের অগ্নিযুগের অমর বিপ্লবী সেই উল্লাসকর দত্ত।