পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়
সেই কোন্ কালে সভ্যতার ঊষালগ্নে মানব সমাজে নারীই ছিলেন সভ্যতার কেন্দ্র বিন্দুতে। আদিতে তখন ছিল মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা। এটাই ছিল প্রাকৃতিক নিয়ম। যা আজও জীব জগতে প্রবহমান। কিন্তু ধীরে ধীরে নানা অছিলায় পুরুষের আদিপত্যের অনুপ্রবেশ ঘটে সামাজিক পরিকাঠামোতে।নারীকে হতে হয় পুরুষের নিয়ন্ত্রনাধীন,পরাধীন। নারীর স্থান হয় অবহেলায়,বঞ্চনায়,শোষনের যুপকাষ্ঠে। নারী হয়ে ওঠে দাসী,ভোগ্যবস্তু,সকল প্রকারের অসাম্যের শিকার।
তার প্রামান্যতা মেলে শতাব্দীর পর শতাব্দীর মানব সভ্যতার ইতিহাসের পাতায়।
১৮৫৭ সালের ৮ই মার্চ,আমেরিকার নিউইয়র্ক শহরের রাস্তায় সেখানকার কটন্ মিলের (সুতো কারখানার) নারী শ্রমিকদের এক বিরাট প্রতিবাদী মিছিল হয়। নারী শ্রমিকদের মজুরী বৈষম্য, কাজের সময় নির্দিষ্ট করা, কাজের জায়গার অমানবিক পরিবেশ ঠিক করা, নারীর ওপর নানান ধরনের অন্যায় অবিচার,অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে ছিল সেই মিছিল। স্থানীয় সরকারের পুলিশের অকথ্য অত্যাচার চালানো হয় সেই মিছিলে অংশগ্রহন কারী নারী শ্রমিকদের ওপরে। রক্তাক্ত হয়েছিলেন নারী শ্রমিকরা,রক্তাক্ত হয়েছিল পথ, মারাও গিয়েছিলেন বেশ কয়েকজন নারী। এর প্রতিবাদে প্রতিবাদ শুরু হোল,প্রতিবাদ চলতে লাগলো বিভিন্ন জায়গাতে। সুদীর্ঘ প্রায় ৫০ বছর ধরে বিভিন্ন দেশে দেশে, বিভিন্ন সময়ে ঘরে বাইরে,কাজের ক্ষেত্রে নারীদের বিভিন্ন ধরনের সমস্যা নিয়ে প্রতিবাদ আন্দোলন ধারাবাহিকভাবে সংঘটিত হয়েছিল।
এরপর,১৯০৯ সালের ২৮ শে ফেব্রুয়ারী, অনুষ্ঠিত হয় আমেরিকায় সর্বপ্রথম আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন।অন্যতমা নেতৃত্ব ছিলেন জার্মান সমাজতান্ত্রিক নেত্রী ক্লারা জেটকিন্। সহায়তায় ছিলেন নিউইয়র্কের সোস্যাল ডেমোক্রেটিক নারী শ্রমিকদের সংগঠন। পরের বছর ১৯১০ সালে ডেনমার্কের কোপেনহেগেন্ শহরে দ্বিতীয়বারের আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল সারা দুনিয়ার ৩৭ টি দেশের প্রায় ১৫০ জন নারী প্রতিনিধিদের নিয়ে। সেখানেই প্রস্তাব ওঠে এবং সিদ্ধান্ত হয় যে,১৯১১ সালের ৮ ই মার্চ সারা বিশ্বে নারীদের সব ক্ষেত্রে সমানাধিকারের দাবীতে “নারী দিবস” হিসাবে পালন করা হবে।
সভ্যতার সর্বক্ষেত্রে অভাবনীয় সফলতার পাদপীঠ-এ নারী-পুরুষের সমান অবদান ঐতিহাসিকভাবে অনস্বীকার্য।
নারীর অবদানকে বাদ দিয়ে সমাজের কোন ক্ষেত্রেই কোন উন্নয়ন হতে পারে না।
যদিও এটা আমরা মানি,তবুও যুগ যুগ ধরে নারীদের পুরুষ শাসিত সমাজে বিভিন্ন সময়ে,বিভিন্নভাবে,অন্যায়,অবিচারের,অমানবিকতার শিকার হতে হয়। যা আজকের দিনেও বহমান। আজও নারীকে অবহেলায়,বঞ্চনায়,শোষনের নাগপাশে জীবন অতিবাহিত করতে হয়।যদিও নারী আজ স্বয়ংসিদ্ধা,আত্মবলিষ্ঠ…, সমাজের,সভ্যতার সব ক্ষেত্রে। তবুও সমাজের সাধারণ স্তরে নারীর যোগ্য সম্মান আজও সুপ্রতিষ্ঠিত নয়।এটা কলঙ্কজনক,এটা লজ্জার বিষয় এই আধুনিক সমাজে।
কাজী নজরুল ইসলামের সেই অমোঘ লেখাঃ…”পৃথিবীতে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যানকর,// অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর..।”… এই চিরন্তন সত্য কথাটি অনস্বীকার্য, তবুও আজও নারীরা কি সত্যিই সম্পূর্ণভাবে সমাজের, ঘরে বাইরে, সর্বক্ষেত্রে সম্পূর্ণ এবং সমান মর্যাদা পেয়েছেন? বা পাচ্ছন??!!
তাই নারী দিবসের শুধুমাত্র একটি দিন নয়,বছরের প্রতিটি দিনে,প্রতিটি মুহূর্তেই নারীর প্রতি শ্রদ্ধা,সম্মান,তাদের সমানাধিকারের দাবীর লড়াই চলতেই থাকে। তবে স্থির বিশ্বাস একদিন জয় আসবেই,একদিন সভ্যতায় নারীই সত্যই হয়ে উঠবেন অবধারিতভাবে মানব সভ্যতার ইতিহাসে অর্ধেক আকাশ। সেই অপেক্ষাতেই থাকে একদিন প্রতিদিনের বাস্তব জীবনের ইতিহাস।