পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়
বাস্তবিকভাবে বিষয়টি স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছিলেন কবি-মনস্বী মোহিতলাল মজুমদার , তাঁর ” স্বামী বিবেকানন্দের উত্তর সাধক” বিষয়ক আলোচনাতে,:- “স্বামী বিবেকানন্দের মানসপুত্র যে এক অর্থে একমাত্র নেতাজী সুভাষ চন্দ্র-ই, তাহাতে কোনও সন্দেহ নাই। ভারতবর্ষের প্রতি ভালোবাসা একজনের হৃদয়ে বীজরূপে জন্ম নিয়েছিল,যাহা আরেকজনের জীবনে মহীরুহ রূপে ধারণ করিয়াছে। স্বামী বিবেকানন্দই ভারতবর্ষের জাতীয়তাবাদ আন্দোলনের প্রধান স্তোত্রী,পরম ঋত্বিক।”
স্বামী বিবেকানন্দই প্রথম উচ্চারণ করেছিলেন–“Believe that you are born free,and you will be.” ভারতবাসীকে তিনিই প্রথম অঙ্গীকারবদ্ধ করতে আহ্বান জানিয়েছেন -” হে ভারতবাসী, ভুলে যেওনা,জন্ম হতে তুমি মায়ের জন্য,দেশমাতৃকার জন্য বলি প্রদত্ত।”
এই বিবেক দ্যুতিতে উদ্ভাসিত হয়েছিলেন ভারতবর্ষের অগণিত দেশপ্রেমিক বিপ্লবী সন্তান। অবশ্যই উদ্দীপিত হয়েছিলেন সুভাষ চন্দ্রও।
যেদিন স্বামী বিবেকানন্দ এই পার্থিব বন্ধন ত্যাগ করে ১৯০২ সালের ৪ঠা জুলাই,বুধবার চলে গিয়েছিলেন মহাপ্রস্থানের পথে,তখন সুভাষচন্দ্র মাত্র পাঁচ বছরের এক শিশু।
এরপর সুভাষচন্দ্রের বড় হওয়া।শৈশব, কৈশোরেই স্বামী বিবেকানন্দ ছিলেন সুভাষের দীক্ষাগুরু। অনুপ্রেরণার মর্মস্থল।
ছাত্রাবস্থায় সুভাষের পড়ার টেবিলে স্বামী বিবেকানন্দ-এর প্রতিকৃতি,এবং স্বামী বিবেকানন্দ-এর লেখা,বক্তৃতামালা সম্বলিত বইগুলি থাকতো। সুভাষ নিজেকে অনুপ্রাণিত করতেন স্বামী বিবেকানন্দ-এর আদর্শে।শিক্ষা সম্বন্ধে স্বামীজীর মূলকথা -“আত্মনো মোক্ষার্থং জগধ্বিতায় চ।”
স্বামী বিবেকানন্দের প্রতি একনিষ্ঠ অনুপ্রেরণায় সুভাষ ১৯১৩ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষার পরেই তৈরী করেছিলেন একটি গোষ্ঠী, যার নামকরণ করেছিলেন-” Neo- Vivekananda Group.”
স্বামী বিবেকানন্দ-এর মত ও পথই তখন সুভাষ অনুসরণ করে চলেছেন।তাই ১৯১৪ সালের গরমের ছুটিতে বাড়িতে কাউকে কিছু না বলে সুভাষ বেরিয়ে পড়েছিলেন ভারতবর্ষকে জানতে হিমালয়ের পথে।উদ্দেশ্য সন্ন্যাস গ্রহন। বিভিন্ন স্থানে ঘুরে তিনি অবশেষে গিয়েছিলেন পাহাড় থেকে সমতলে। সেই আসার পথেই উপস্থিত হয়েছিলেন তিনি কাশীতে শ্রীরামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের আশ্রমে। তখন সেখানে শ্রীরামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের প্রথম অধ্যক্ষ তথা শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব-এর সাক্ষাৎ শিষ্য এবং স্বামী বিবেকানন্দ-এর গুরুভাই,সহসঙ্গী রাখাল মহারাজ(স্বামী ব্রহ্মানন্দ-জী আশ্রমে অবস্থান করছিলেন। কিশোর সুভাষ-এর স্বামী বিবেকানন্দ-এর প্রতি আকর্ষণ তিনি উপলব্ধি করেন।এবং সদ্য কিশোর সুভাষের কথালাপে তিনি সুভাষকে অনুভব করেছিলেন দরদী মরমী অনুভূতি দিয়ে। সেইদিন রাখাল মহারাজ সুভাষচন্দ্রকে কি বলেছিলেন, সেই কথা স্বয়ং সুভাষচন্দ্র তাঁর বন্ধু দিলীপ কুমার রায়কে(কবি,নাট্যকার দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের পুত্র),পরে বলেছিলেন– ” স্বামী বিবেকানন্দ-এর কৃপা যে পায়,তার জীবন বদলে যায়।– আমিও পেয়েছি এই কৃপা। তাইতো চাই দেশের কাজে এই জীবন ঢেলে দিয়ে সার্থক হতে। এও তোমাকে বলছি,পরমপূজ্য শ্রীরামকৃষ্ণ-এর সাক্ষাৎ প্রতিভূ স্বামী বিবেকানন্দ-এর আদর্শের ভিত্তিতে এবং স্বামীজীর সহসঙ্গী রাখাল মহারাজ (স্বামী ব্রহ্মানন্দ জী) -এর যথাযথ উপদেশে, আমি কাশী থেকে ফিরে এসে ব্রত গ্রহণ করেছি, যে আমাকে দেশের জন্য কাজ করতে হবে প্রাণ দিয়ে।”
তারপর তো এক অন্য ইতিহাসের সূচনা। স্বামী বিবেকানন্দ-এর আদর্শে মন্ত্রপুত সুভাষচন্দ্র, বুকের মধ্যে যাঁর স্বামী বিবেকানন্দ বিরাজ করছেন –আর তিনি এগিয়ে চলেছেন –দেশের জন্য,দেশের মানুষের জন্য মুক্তির পথে,স্বাধীনতার পথে–এগিয়ে চলেছেন বীর সন্ন্যাসী স্বামী বিবেকানন্দ-এর মানসপুত্র সারা বিশ্বের একমাত্র আপোষহীন বীর সেনাধ্যক্ষ নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু। অন্তরের অন্তঃস্থলে তাঁর সদা বিরাজিত ছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ।
আজ স্বামী বিবেকানন্দ-এর পূণ্য জন্মদিনে রেখে গেলাম প্রাণের প্রণতি তাঁর পদপ্রান্তে।