পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়
তিনি নিজেই জানতেন, তিনি গড়পড়তা নন। তিনি কে? তিনি অরুন্ধতী গুহঠাকুরতা। জন্ম ঢাকায়। ১৯২৪ সালের ২৯ এপ্রিল।
পৈতৃক বাড়ি বরিশালে। বাবা বিভুচরণ গুহঠাকুরতা ছিলেন আইনজীবী। খুবই ধার্মিক মানুষ ছিলেন। মন্দির,মসজিদ,গীর্জা,ব্রাহ্মসমাজ,–সব পবিত্রস্থানেই তিনি অংশ গ্রহন করতেন। আর ছিলেন সঙ্গীত পিয়াসী মানুষ। অরুন্ধতীর সঙ্গীত শিক্ষা বাবার কাছেই। পড়াশোনা ঢাকাতেই শুরু। বাবার মৃত্যুর পরে কলকাতায় এসে পড়াশোনা এবং এখান থেকেই ম্যাট্রিক পাশ করা। পিসি লাবণ্যলতা চক্রবর্তী এবং পিসেমশাই অজিত কুমার চক্রবর্তী ছিলেন রবীন্দ্রনাথের স্নেহধন্য। সেই সুত্রেই ১৯৪০ সালে মা চারুপ্রভার সাথে শান্তিনিকেতনে শৈলজারঞ্জন মজুমদারের কাছে গান শেখা শুরু। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ অরুন্ধতীর গান শোনেন।
এক সন্ধ্যায় নাট্যঘরে রবীন্দ্রনাথের সামনে অরুন্ধতী। গান গাইছেন তিনি–“এবার উজাড় করে..”,গাইতে গাইতে অরুন্ধতীর খেয়াল হোল,তা গানের সাথে গলা মেলাচ্ছেন আর একজনও –তিনি রবীন্দ্রনাথ। গানের শেষে গুরুদেবের কথায় আবার গান শুরু করলেন অরুন্ধতী — “আমার কী বেদনা..”।
মোহিত হয়ে শুনলেন কবিগুরু। বললেন– “গান শেখো, কিন্তু চলে যেও না।”
গানের পরীক্ষাতে নুকু(অরুন্ধতী) প্রথম,দ্বিতীয় মোহর(কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়)।
১৯৪৬ সাল অবধি ছিলেন শান্তিনিকেতনে। তারপর কলকাতায় চলে আসা।কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইকনোমিকস্-এ এম.এ. পাশ করা। তারপর কিছুকাল সাংবাদিকতার শিক্ষানবিশী। এর পাশাপাশি রেডিওতে গান গাইলেন অরুন্ধতী। সহ সঙ্গী হিসাবে পেলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়,দেবব্রত বিশ্বাস,প্রমুখদের।
এরপর ১৯৫০ সালে অভিনয় জগতে প্রবেশ। “মালঞ্চ” ছবির নায়িকা হিসাবে বিজ্ঞাপন দেখে যোগাযোগ করেও ব্যর্থ হওয়া। অভিনয়ের সুযোগ এলো ১৯৫২ সালে।সেই শুরু–মহাপ্রস্থানের পথে,হিন্দীতে যাত্রিক। নদ ও নদী,ছেলে কার,গোধুলী,নবজন্ম,দু’জনে,চলাচল,
পঞ্চতপা,মানময়ী গার্লস স্কুল, শশীবাবুর সংসার,বিচারক,ক্ষুধিত পাষাণ, ঝিন্দের বন্দী, শিউলিবাড়ি, ভগিনী নিবেদিতা,জতুগৃহ, হারমোনিয়াম, ইত্যাদী।
পরিচালক হিসাবে সিনেমা করলেন পদীপিসির বর্মীবাক্স,দীপার প্রেম,ছুটি, মেঘ ও রৌদ্র,ইত্যাদি। টেলিফিল্ম গোকুল।
ইচ্ছে ছিল বনফুলের মৃগয়া,আর মহাশ্বেতা দেবীর হাজার চুরাশির মা গল্প অবলম্বনে সিনেমা করার,কিন্তু ১৯৯০ সালে সব ইচ্ছেগুলো থমকে থেমে গেল।অরুন্ধতী দেবী চলে গেলেন।
বাংলা সঙ্গীত এবং চলচ্চিত্রে অরুন্ধতীর অবদান অনস্বীকার্য। অরুন্ধতী সেই অবিশ্বাস্য নক্ষত্রের এক নাম, যিনি নিজের গতি সুনিয়ন্ত্রণ করতে জানেন,এবং পারেন। ১৯৯০ এর ১৬ ই অক্টোবর চলে গেলেন সব কিছু ছেড়ে।
জন্মশতবর্ষ উদযাপনে অরুন্ধতী দেবীর প্রতি রইল বিনম্র শ্রদ্ধা এবং প্রণাম।