পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়
২১ জুন “বিশ্ব সঙ্গীত দিবস”–সেই পরিপ্রেক্ষিতে একটা প্রশ্ন জাগে মনে,– “আচ্ছা গান বা সঙ্গীত কি নিছকই বিনোদনের জিনিস মাত্র?” অবশ্য বহুকাল,বহুযুগ ধরেই সঙ্গীতকে সেই রকমটাই ভাবা হোত।
আচ্ছা সঙ্গীত আগে না ভাষা আগে? অনেকে বলতেন ভাষা আগে। তারা মনে করতেন, যে মানুষের বাঁচার জন্যে গানের কোনও ভুমিকাই নেই,নেই কোনও প্রত্যক্ষ উপযোগিতা। কিন্তু এখন বিবর্তনতত্ত্ব, “Cognitive Musicology”
(কগনিটিভ মিউজিকলজি) বলছে অন্য কথা।
ভাষাতত্ত্ববিদ এলিসন রে(Allison Rey),প্রত্নতাত্ত্বিক স্টিভেন মাইথেন (Steven Mythen), প্রমুখরা বলছেন, যে এই ভাষাকেই বরং দীর্ঘ সাঙ্গীতিক পর্ব পেরিয়ে জন্ম নিতে হয়েছে। প্রাণের সভ্যতায় একটা আদি ভাষা ছিল,সেটা সঙ্গীত-ভাষা (Musi language/মিউজিল্যাঙ্গুয়েজ), সেই উৎস থেকেই ভাষা এবং সঙ্গীত -দুইয়েরই সৃষ্টি হয়েছে। ভাষা ও গানের জন্য আমাদের মস্তিষ্কের মডিউলের সমাহার পরস্পরের থেকে পরস্পর আলাদা,মস্তিষ্কের যে সব অংশতে সঙ্গীতের উৎস, সেগুলি আমাদের মানুষ হয়ে ওঠার অনেক অনেক আগে থেকেই বিবর্তিত। সঙ্গীতের সাথে তাই নাচের পরম আত্মীয়তা। তাই আকাশে মেঘেদের ঘনঘটা দেখে যেমন আমাদের “মন মোর মেঘের সঙ্গী” হতে চায়,তেমনই ময়ুরেরও পেখম উন্মুক্ত হয়,তেমনই মিলন পিয়াসে “দাদুরী ডাকিছে উল্লাসে”।
আসলে সঙ্গীতের মৌলিক অবস্থানের নাম ছন্দ।সেই ছন্দ এসেছে প্রানীর,মানুষের জীবন যাপনের মাধ্যমে।নানান দেহভঙ্গীতে ছন্দের জন্ম হয়।নানান ভাষায়,সুরের ব্যবহার ছন্দের ওপরে প্রতিষ্ঠিত। এ এক স্বভাবগত আবেগ।
তাই সেই আবেগের মতই সঙ্গীত আমাদের বড় ভিতরের আত্মীয়,একান্ত আপন,শরীরের গভীরে নিবিড়তায় তা প্রোথিত। শরীরী অভিব্যক্তিতে তার পরিচয় –হাতে পায়ে তাল দেওয়া,কখনো কখনো সারা শরীরে আন্দোলন। শুধু গায়ক বা গায়িকা একা গাইছেন না,শ্রোতারাও মনে মনে গাইছেন সেই গান,যুক্ত হয়ে যাচ্ছেন সুরে সুরে, তালে তালে।
সঙ্গীত শুধু আমাদের জীবনের শক্তিই জোগায় না,সঙ্গীত অন্যের মধ্যে আবেগ সঞ্চারেও অত্যন্ত ইতিবাচক সহায়ক। আর সেটাকেই আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানে বলা হয়
” musicotherapy “(মিউজিকথেরাপি)। আর আবেগ তো সার্ব্বজনীন,তাই তাকে বোঝা যায় এই মনেরই একতারাতে যে সুর বাজে, সেই সুরের ভাষায় ভাষায়। ওই যে সেই কবে বলেছিল গুপী গায়েন–” এ যে সুরেরই ভাষা,ছন্দেরই ভাষা,/ ভাষা এমন কথা বলে বোঝেরে সকলে..”।
ঠিকই তাই,বিগত শতকের পাঁচের দশকের গোড়ার কথা– ফ্রান্সের একটি বিরাট মিউজিক কনফারেন্সে মাঝরাতে মঞ্চের মধ্যমনি হয়ে বসে আছেন এক ভারতীয় সঙ্গীতজ্ঞ উস্তাদ–উস্তাদ বাবা আলাউদ্দিন খাঁ সাহেব– শুরু হোল সরোদের মুর্ছনা। বাজছে মধ্যনিশীকালীন রাগ। সেই রাগ নিবিষ্ট মনে শুনতে শুনতে
উপস্থিত সকলের মধ্যে মনে মনে এক উদাসীনতা ভাব জেগে উঠছে। শ্রোতাদের আসনে বসে ছিলেন স্বয়ং ফরাসী প্রেসিডেন্ট মিঃ দ্য গল্।সেদিন সরোদের তন্ত্রীতে তন্ত্রীতে যে সুর,যে রাগের স্বরগম বাজিয়েছিলেন উস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ সাহেব,তার প্রভাবে তার সুরের মুর্ছনায় সেদিন প্রেসিডেন্ট মিঃ দ্য গলের
চোখে জল এসে গিয়েছিল। মিশে গিয়েছিল সুর আর সঙ্গীত অন্তরে অন্তরে।
ভাষা যেখানে পথ হারিয়ে ফেলে,সেখানে গানই আলোকিত করে পথের ঠিকানা।তাই তো,রবি ঠাকুর আমাদের দিয়ে যান সুর ও বাণীর উপহারে,–” নয়নে আঁধার রবে,ধেয়ানে আলোকরেখা”।
সঙ্গীতের উর্ধ্বে আর কোনও বিদ্যা নেই। সাধনার একমাত্র সোপান হোল এই সঙ্গীত–তা হোক বেদগানে,সামগানে,
গীর্জার প্রার্থনায়,মসজিদের আজানে,গুরুদ্বারের সন্ত-সাধনায়,সবখানে,সব যুগে।
সঙ্গীত আমাদের জন্মের আগে থেকেই, একলা যখন মায়ের গর্ভান্তরে,তখন থেকেই।মা আর সন্তানের সংযোগে বিনিসুতোর মালা হোল সঙ্গীত।ঘুমপাড়ানি গান,কোলে দোল খাওয়া,সুরে ছন্দে স্বরবর্ণ ব্যঞ্জনবর্ণ শিক্ষা,ভেঙে ভেঙে শব্দ শেখা, সবই সেই সঙ্গীতের ভাবধারার হাত ধরেই বিভিন্ন সময়ে,বিভিন্ন রূপে মানুষের বড়ো হওয়া।
একমাত্র সঙ্গীতই হয়ে ওঠে সামাজিকতার ঐক্যবন্ধনের মাধ্যম। ব্যক্তি সুখ দুঃখের অভিব্যাক্তির প্রকাশ,সমষ্টির মধ্যে তা প্রকাশ পায়,কারন ব্যক্তি এক সময়ে বহুবচনে সমষ্টি হয়ে যায়।জন্ম নেয় লোকসঙ্গীত,জন্ম নেয় গণসঙ্গীত।জন্ম নেয় সমবেত সঙ্গীত। সভ্যতার শুরু থেকেই প্রানের একক চলার পাশাপাশি সমবেতভাবে এগিয়ে চলার অভ্যাসগত স্বাভাবিক স্বভাব দেখা যায়।
সঙ্গীত দিবসের উদযাপনে প্রাণের আলাপ হিসাবেই গানের, সুরের কথা ভাবতেই হয়। যা সমবেত স্তরে আমাদের সবার প্রাণে প্রাণের আকর্ষণ জাগ্রত হয়ে থাকুক।
এই সময়টা বড্ড উদভ্রান্ত।এখন দেখছি ধর্ম মানুষকে অসীমের সন্ধান না দিয়ে কেমন যেন ছোট ছোট খাঁচায় পুরে কারা যেন ইচ্ছেমতো এর বিরুদ্ধে ওকে,মোর বিরুদ্ধে তোকে, যেমনখুশি,যখন খুশি যেনতেন প্রকারেন পুতুলের মতো নাচায়।
ভাষা কিন্তু যেমন সমাজবন্ধনে সাহায্য করে,আবার দুরত্ব, ভুল বোঝাবুঝির তথা বিভেদ আর কলহেরও জন্ম দেয়।কিন্তু গান শুধুই প্রাণের সাথে প্রাণের মিলন ঘটায়।
তাই এখন “কোলাহল তো বারন হোল..”, এবার শুরু হোক প্রাণের আলাপ,সুরে ও সঙ্গীতের কানে কানে।
” আমি কান পেতে রই,ও আমার আপন হৃদয় গহন দ্বারে, বারেবারে,শুনিবারে..”
“কাহার গলায় পরাবি গানের রতনহার…”
সেই আদি শব্দে আজ ভেসে যাক গান,ভালোবাসায় ভেসে যাক গান..”ন বিদ্যা সঙ্গীত পর” সঙ্গীতের চেয়ে পরম বিদ্যা আর কিছুই নেই।
তাই, আজ “গানের ভিতর দিয়ে যখন দেখি ভুবন খানি,// তখন তোমায় চিনি,তখন তোমায় জানি..”