পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়
পার হয়ে যায় জন্মের প্রথম শুভক্ষণের ১২৫ বছর। এসো এসো তুমি,মুখোমুখি নাহয় হলাম আমি আর আমার ভালোবাসার জন্মভূমি। প্রাণের সুখেদুখে যে বিনিসুতোর মালা,যার প্রতিটি গ্রন্থিতে জেগে থাকে অনন্তদীপশিখায় যে আনন্দ,তাই তুমি,তাই আমার ভালোবাসার জন্মভুমির আঁচল জুড়ে চিরন্তন শাশ্বত সত্য হয়ে থেকে যাও,সেটাই বুঝি জীবনের ছন্দ–তুমিই জীবনানন্দ।
ক্রিক রো দিয়ে ফেরার সময়ে এক ফৌজী অফিসার পথচলতি জীবনানন্দের বুকেতে বন্দুকের নল ঠেকিয়ে তাঁকে ট্রাকে তুলে দিতে দিতে সেদিন বলেছিল-” I think you are a ring leader of this area..just get on.” এই ঘটনাটি ঘটেছিল ১৯৪৬ সালের শেষের দিকে। পরাধীন ভারতবর্ষের বুকে তখন ছিল সাম্প্রদায়িক ধ্বংসাত্মক রক্তাক্ত হানাহানির লুটতরাজ,নারীর সম্মান হানির প্রেক্ষাপট।
থানার বেঞ্চিতে বসে আছেন নিশ্চুপ কবি।অপেক্ষা করছেন বিচারের,প্রশাসনের সিদ্ধান্তের। ওদিকে চারিদিকে পুলিশ ফৌজীদের হম্বিতম্বি। হঠাৎ,এক অল্পবয়সী পুলিশকর্তা এসে কবিকে প্রণাম করে মাথা নীচু করে সবিনয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলেন “স্যার আপনাকে এখানে কে…?” কথা অসমাপ্ত রেখেই হাতজোড় করে তিনি ক্ষমা চাইলেন।উপস্থিত সকলকে নির্দেশ দিলেন কবির কাছ থেকে ক্ষমা চাওয়ার। সেই পুলিশকর্তাই থানার ও.সি। কবি তখন নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে সকলকে নমস্কার জানালেন। সেই ও.সি ছিলেন বরিশালের বি.এম কলেজে জীবনানন্দ দাশের ছাত্র। এরপর সেই অফিসারই রাষ্ট্রের হাতে ধৃত এবং “ডিটেনড” কবিকে সসম্মানে নিজেই বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছিলেন। এই কাহিনী জানা যায় জীবনানন্দের ডায়েরি থেকে। পরে জীবনানন্দই লিখছেন ক্ষমতা আর কবির সম্পর্কের বিষয়ে–“কোনো এক কবি বসে আছে ‘…কারাগারে ক্যাম্পে অন্ধকারে “।
জীবনানন্দ দাশ সেই মানুষ, সেই কবি যিনি ” উনুনের অতলে দাঁড়িয়ে “দেখেছিলেন একদিকে ” নরকের আগুনের মতো অহরহ রক্তপাত ” আর “প্রভাতের গোধূলির রক্তছটা-রঞ্জিত ভাঁড়”–,যিনি আজও এইসময়ের চারিদিকে ঘটে যাওয়ার ঘটিনার প্রেক্ষিতে সমকালীন এবং প্রাসঙ্গিক।
আসলে জীবনানন্দ মানুষের মনকে,তার মুডকে খুব গভীরভাবে অনুধাবন করতেন নিজের অনুভবের আয়নায়। তাই তিনি আজও, এই আজকের দিনেও আমাদের মুখোমুখি হতে পারেন সহজেই অত্যন্ত আপন জনের মতো।
রবীন্দ্রনাথকে লেখা একটি চিঠিতে জীবনানন্দ জানিয়েছিলেন –” মানুষের মনে নানা সময়ে নানা রকম moods খেলা করে।…Moods-এর প্রক্রিয়ার নানা-র ভেতর এই যে সুরের আগুন জ্বলে ওঠে..। সকল বৈচিত্র্যের মতো সুরবৈচিত্র্যও আছে সৃষ্টির ভেতর।.. বীঠোফেনের কোনো কোনো Symphony বা Sonata – র ভেতর অশান্তি রয়েছে,আগুন ছড়িয়ে পড়ছে।।”
জীবনানন্দ সম্ভবত তাঁর সমস্ত সৃষ্টিপ্রক্রিয়ায় এই বিমূর্ত সঙ্গীত আর অনুভূতিময় মেজাজকেই ধরতে চেয়েছিলেন।এমন কি কবির গদ্য রচনাতেও তিনি ঘটনা থেকে সরে আসতে চেয়েছেন সঙ্কেতে,কবিতার মতোই তাকে ঘটনাবিহীন ইশারায় পরিবেশন করতে চেয়েছেন।তাই বুঝি কবিতার নাম দেন তিনি, “অবসরের গান”, ” কোরাস”, “বিভিন্ন কোরাস”, ” রাত্রির কোরাস”, “নব হরিতের গান”, ইত্যাদি। একবার নিজেই ১৯৪৪ সালে দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় কে লেখা একটি চিঠিতে জীবনানন্দ জানাচ্ছেন,যে
” আলোকস্তম্ভ” কবিতাটির অনুবাদ তিনি নিজেই করেছেন,নাম দিয়েছেন “Antiphony “। এই যে সঙ্গীতের বিমূর্ততা দিয়ে এক বিশেষ মুড এবং মনোকনিকাকে স্পর্শ করা,ছোঁয়ার চেষ্টা, এই হোল জীবনানন্দের নির্জন স্বাক্ষর। মহৎ কিবি কখনোই কালের,সমাজের সীমাবদ্ধ হন না।তিনি কালোত্তীর্ণ।
নিসর্গ, মৃত্যুবোধ,শূন্যতা, একাকিত্ব, আর বিপদের জীবনানন্দ বনাম সমাজ,ইতিহাস, মানবমুক্তি,মহাপৃথিবী মহাজিজ্ঞাসার জীবনানন্দ –এমন খোপকাটা বনাম বদ্ধতা ভেঙেচুরে আরও অসংখ্য, বহুধা জীবনানন্দ যেন আমাদের সামনে এসে দাঁড়ায়।
ভুমেন্দ্র গুহকে একবার জীবনানন্দ বলেছিলেন,– “আমি তো এককালে গানও লিখেছিলাম,জানো?”
আমরা যদি সেই গানের মধ্যেও জীবনানন্দকে খুঁজে দেখি, তাহলে পাবো এক অনন্যসাধারণ মানুষ কে..
“এই কি জীবন? জেগে থাকা?/ অমৃতেরই হাওয়া?/ জ্যোতিষ্কদের ঘুম ভাঙানো?/ নারীর দেখা পাওয়া?”
নিশ্চয়তার বিলাস নয়,ক্ষতজর্জর প্রশ্নমালার জীবনানন্দ আমাদের সহচর,আমাদের আত্মার অস্তিত্বে পরমআত্মীয়,আমাদের অগ্রপথিক।