প্রথম পাতা প্রবন্ধ কত অজানারে এবং রবীন্দ্রনাথ…

কত অজানারে এবং রবীন্দ্রনাথ…

241 views
A+A-
Reset

পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়

আজ ২৫শে বৈশাখ,আমাদের একমাত্র অন্যতম অহংকার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মের প্রথম শুভক্ষণ…
সকলের অন্তরের একতারায় আজ বেজে চলে সেই বানী,সেই সুর…”হে নূতন দেখা দিক আর বার জন্মেরও প্রথম শুভক্ষণ…”।

কবিগুরুর প্রথম জন্মদিন পালন করা হয়েছিল কবে? এই কৌতুহলের উত্তরে আমরা জানতে পারি রবীন্দ্রনাথের ভাগিনেয়ী (বড়দিদি স্বর্ণকুমারী দেবীর মেয়ে) সরলা দেবী তাঁর আত্মকথা “জীবনের ঝরাপাতা “-তে লিখছেন..” রবি-মামার প্রথম জন্মদিন-উৎসব আমি করাই। তখন মেজমামা(সত্যেন্দ্রনাথ) ও নতুনমামার(জ্যোতিরিন্দ্রনাথ) সঙ্গে তিনি(রবীন্দ্রনাথ) ৪৯নং পার্ক স্ট্রিটে থাকেন। অতি ভোরে উল্টাডিঙির কাশিয়াবাগান বাড়ি থেকে পার্ক স্ট্রিটে নিঃশব্দে তাঁর ঘরে তাঁর বিছানার কাছে গিয়ে বাড়ির বকুলফুলের নিজের হাতে গাঁথা মালা ও বাজার থেকে আনানো বেলফুলের মালার সঙ্গে অন্যান্য ফুল এবং একজোড়া ধুতি চাদর তাঁর পায়ের কাছে রেখে প্রনাম করে তাঁকে জাগিয়ে দিলুম। তখন আর সবাই জেগে উঠলেন।…সেই বছর থেকে তাঁর জন্মদিনের উৎসব আরম্ভ হোল।” এখানে জানাই সেই বছরটি ছিল ১২৯৪ বঙ্গাব্দের ২৫শে বৈশাখ (১৮৮৭ সালের ৭ই মে// কবির বয়স তখন ২৫ পেরিয়ে ২৬শে পদার্পন)।

রবীন্দ্রনাথ তখন ১৬/১৭ বছরের।বিলেত যাওয়ার আগে ইংরেজি ভাষা আর বিদেশি আদবকায়দা শেখার জন্য মেজদাদা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথামতো বোম্বাইয়ের এক অভিজাত মারাঠি পরিবারে বেশ কিছুদিন কবি বসবাস করেছিলেন।সেই পরিবারের বিলেত ফেরত শিক্ষিতা,স্মার্ট ব্যক্তিত্বের সুন্দরী মার্জিতা বড় কন্যা আন্না তড়খড়ের সাথে কবির ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল। হয়তোবা,সেটাই ছিল কবির জীবনের প্রথম অনুচ্চারিত গোপন ভালোবাসা। ভালোবেসে কবি আন্না তড়খড়ের নাম দিয়েছিলেন “নলিনী”। আন্না সেই নামটিই লেখালিখিতে ব্যবহার করতেন আজীবন । শুধু তাই নয়,নিজের ভাইপোর নাম রেখেছিলেন “রবীন্দ্রনাথ”…। শোনা যায় কবির প্রথম প্রেমের নায়িকা ছিলেন এই আন্না।

রবীন্দ্রনাথের প্রথম প্রকাশিত নাটক হল ” বাল্মিকী প্রতিভা”(প্রকাশ ১৮৮১ সাল)। আগে এই নাটকের নাম ছিল “রুদ্রচন্ড”।

রবীন্দ্রনাথ ৮ বছর বয়সে প্রথম কবিতা লেখেন… “আমসত্ত্ব দুধে ফেলি,তাহাতে কদলি দলি,সন্দেশ মাখিয়া দিই তাতে,//হাপুসহুপুস শব্দ,চারিদিক নিঃস্তব্ধ,পীপিড়া কাঁদিয়া যায় পাতে।”

প্রথম প্রকাশিত কবিতা “অভিলাষ” প্রকাশ হয়েছিল “ভারতী” পত্রিকায়।কবির বয়স তখন ১৪ বছর।

রবীন্দ্রনাথের বয়স তখন ১৩ বছর ১০ মাস। তিনি জীবনের অভিজ্ঞতায় প্রথম মৃত্যু-কে দেখেছিলেন। তাঁর মা সারদা সুন্দরী দেবী মারা যান। মায়ের৷ অকাল-মৃত্যু বালক রবীন্দ্রনাথকে বিহ্বল করে তুলেছিল। সেইকথা তিনি “জীবন স্মৃতি “-তে লিখে রেখে গেছেন চোখের জলে।

কবির লেখা প্রথম নাটক “পৃথ্বীরাজ পরাজয়”… নাটকের পাণ্ডুলিপি কবির জীবদ্দশাতেই হারিয়ে যায়।

কবির স্বাক্ষর যুক্ত কবিতা প্রথম প্রকাশ হয়েছিল ১৮৭৫ সালে, অমৃতবাজার পত্রিকায়। কবিতার নাম “হিন্দু মেলার উপহার”।

১৮৭৭ সালে রবীন্দ্রনাথ প্রথম মঞ্চাভিনয় করেন,নতুনদাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাটক ” অলীক বাবু”-তে। জোড়াসাঁকোর বাড়িতে।

কবির প্রথম প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ “কবিকাহিনী” প্রকাশ হয়েছিল ১৮৭৮ সালে।

কবির প্রথম গদ্যগ্রন্থের নাম হল ” য়ুরোপ প্রবাসীর পত্র”..।

রবীন্দ্রনাথ প্রথম উপন্যাস লেখেন,যার নাম ছিল “করুণা”… কিন্তু সেটা অসম্পূর্ণ অবস্থাতেই থেকে যায়। ১৮৮৩ সালে রবীন্দ্রনাথের প্রথম উপন্যাস ” বৌ ঠাকুরানীর হাট” প্রকাশিত হয়।

রবীন্দ্রনাথের প্রথম গান হল..
” গগনের থালে রবি চন্দ্র দীপক জ্বলে…”(এই গানটি শিখ সন্ত গুরু নানকের ভজন..”গগন মে থাল,রবি চন্দ্র দীপক বনে..” এর আক্ষরিক অনুবাদ..।)

এই গানটির পরের লাইনগুলি কবির নিজস্ব মননশীলতায় লেখা।এটি “তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা”-র ১৮৭৫ সালের জানুয়ারী মাসের(১২৮১ বঙ্গাব্দের মাঘ-ফাল্গুন) সংখ্যাতে প্রকাশিত হয়।

রবীন্দ্রনাথ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ছদ্মনামে লিখেছেন। সেই ছদ্মনামগুলি হোল…
(১) ভানুসিংহ ঠাকুর (২) ভানুসিংহ, (৩) অপ্রকট চন্দ্র ভাস্কর, (৪) দিকশূন্য ভট্টাচার্য, (৫) নবীন কিশোর শর্মন, (৬) ষষ্ঠী চরন দেব শর্মন, (৭) শ্রী বানীবিনোদ বিদ্যাবিনোদ, (৮) শ্রীমতী কনিষ্ঠা, (৯) শ্রীমতী মধ্যমা, (১০) শ্রী রবীন্দ্র শর্মা,
(১১) শ্রী রঃ, (১২) র..,(১৩) শ্বম্বদ্ শ্রী, (১৪) ভ.., (১৫) আন্নাকালি পাকড়াশি।

পয়লা বৈশাখ, ১৯৪১ সাল।রবীন্দ্রনাথের জীবনের শেষ নববর্ষ। ১৯৩৬ সাল থেকে (কবির বয়স তখন ৭৫ বছর) রবীন্দ্রনাথের জন্মদিনের উৎসব পালিত হতে শুরু হয় এই পয়লা বৈশাখ তারিখে,নববর্ষের দিনেই শান্তিনিকেতনের আশ্রমে।

১৯৪১ সালের ১লা বৈশাখ তারিখেই বিশ্বকবি লিখেছিলেন সেই কালজয়ী গান..” ঐ মহামানব আসে,দিকে দিকে রোমাঞ্চ লাগে…”। এই প্রসঙ্গে রবীন্দ্র স্নেহধন্য এবং কবির সান্নিধ্যে থাকা শান্তিদেব ঘোষের লেখা থেকে আমরা জানতে পারি… “জানো…সৌম্য (সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর) আমাকে বলেছে মানবের জয়গান গেয়ে একটা কবিতা লিখতে। সে বলে আমি যন্ত্রের জয়গান গেয়েছি,মানবের জয়গান করিনি। তাই একটা কবিতা রচনা করেছি,সেটাকেই গানে রূপ দেব।সেটাই হবে নববর্ষের গান,আমার জন্মদিনের গান।”

শান্তিদেব ঘোষ আরও লিখছেন..” কাছেই ছিলেন শ্রীযুক্তা মৈত্রেয়ী দেবী,তিনি গুরুদেবের খাতা খুলে কবিতাটি কপি করে আমাকে দিলেন। কবিতাটি ছিল একটু বড়ো, দেখে ভাবলাম এতো বড়ো কবিতায় সুরযোজনা করতে বলা মানে তাঁকে কষ্ট দেওয়া।তবু তিনি সুর দেবার একটু চেষ্টা করে সেদিন আর পারলেন না,বললেন… “কালকে হবে…”।
পরের দিন সেই কবিতাটি সংক্ষেপ করতে করতে শেষ পর্যন্ত বর্তমানের “ঐ মহামানব আসে…” গানটি যে আকারে আছে,সেই আকারে তাকে পেলাম।…”

“ঐ মহামানব আসে,/ দিকে দিকে রোমাঞ্চ লাগে,মর্ত্য-ধুলির ঘাসে ঘাসে।।
সুরলোকে বেজে ওঠে শঙ্খ,/ নরলোকে বাজে জয়ডঙ্ক,/ এলো মহাজন্মেরও লগ্ন…।/ আজি অমারাত্রির দূর্গতোরন যত/ ধূলিতলে হয়ে গেল ভগ্ন।/ উদয়শিখরে জাগে ‘মাভৈঃ মাভৈঃ’/ নবজীবনের আশ্বাসে।/ ‘জয় জয় জয় রে মানব-অভ্যুদয়’/ মন্দ্রি-উঠিল মহাকাশে।।”

১৯৪১ সালের শেষ নববর্ষ এবং এই মহামানবের জন্মের প্রথম শুভক্ষণেরও (কবির জীবদ্দশায়) শেষ মহোৎসব..।

তারপর নিয়তির অমোঘ বিধানে অপেক্ষায় ছিল সেইদিন,যেদিন শ্রাবনের ধারার মতো ঝরে পড়েছিল সুরলোকে, নরলোকে জীবনের, প্রাণের ব্যক্ত-অব্যক্ত কান্না… এসেছিল রবির চির অস্তাচলের সেই মহাক্ষন…২২ শে শ্রাবন…।

আধুনিক কবির কথায়….
“আমাদের সমস্ত ভাবনায় তিনি,প্রতিদিন,প্রতিরাত…//
মায়ের মতো,বাবার মতো আগলে রাখেন রবীন্দ্রনাথ।”

বাংলা ও বাঙালির শিরায় শিরায়,রক্তধারায় স্রোতস্বিনীর মতো বয়ে চলা এক অন্যতম সংস্কৃতির নাম হলো ২৫ শে বৈশাখ এবং রবীন্দ্রনাথ….বিনম্র প্রনাম।

আরও খবর

মন্তব্য করুন

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

সম্পাদকের পছন্দ

টাটকা খবর

©2023 newsonly24. All rights reserved.