পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়
১ মার্চ, ২০২৫ (১৭ ফাল্গুন,১৪৩১ বঙ্গাব্দ) শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব-এর পূণ্য আবির্ভাবের পবিত্র দিনে আমাদের মতো করে একটু তাঁকে যদি প্রণাম জানাই,ভাবনায় মিশিয়ে দিই,মনে মনে প্রস্তুতি নিই,যে তাঁর দেখানো সহজ সরল পথে জীবনটাকে অতিবাহত করবো,ক্ষতি কি? বরঞ্চ, এক অতীন্দ্রিয় সত্য আমাদের অন্তরে ধীরে ধীরে ভোরের সূর্যোদয়ের মতো উদিত হবে।সেই আলোকচ্ছটায় ভেসে যাবে অন্তরের অঙ্গন,ভেসে যাবে বাহিরের প্রাঙ্গণ।
কত সহজ ছিলেন তিনি। কি মহাকর্ষতায় আকর্ষণ করতেন মানুষকে। স্কুলের মাস্টার,মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত,এক বিড়ম্বিত জীবন নিয়ে প্রাণান্তকর অবস্থা,আত্মহননের চরম সিদ্ধান্ত মনে মনে নিয়ে ঘরে বেড়াচ্ছেন।শেষে পৌঁছেছিলেন সেই গঙ্গা-শিপ্রা নদীর মহাপূণ্য-শান্তি পীঠের এক পল্লীবাংলার আটপৌরে মানুষের কাছে,যিনি সারাক্ষন বিভোর হয়ে আছেন উমাময়ী ভবতারিণীর শ্রীচরণ দুটিতে। পেলেন শান্তি।আর কোথাও গেলেন না।খুঁজে পেলেন নিজেকে।লিখে চললেন নিত্য কথোপকথন, জন্ম নিল “কথামৃত”।
দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো সেই সময়ের প্রভাবশালী মানুষ চেয়েছিলেন,বারবার অনুরোধ করেছিলেন, যে দক্ষিণেশ্বরের মা ভবতারিণীর সেবক,রানী রাসমনি,আর মথুরামোহন বিশ্বাসের “ছোট ভটচায্যি” যেন ব্রাহ্ম সমাজের “আচার্য” হন। হাসিমুখে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন সেই অনুরোধ।
আসলে তিনি,আমাদের শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব আমাদের আত্মার পরমাত্মীয়। তিনি আমাদের শেখান মুল্যবোধ।তিনিই আমাদের অন্তরে যে মায়ান্ধকারের আচ্ছন্নতা, তাকে জ্ঞানের আলোকপাতে পরিচ্ছন্ন করে দেন।তিনিই আহ্বান জানান,”শিব জ্ঞানে জীবের সেবা” করো।
তিনিই সারা বিশ্বে, মানবসভ্যতার ইতিহাসে প্রথম প্রমান করলেন নিজের জীবনের সাধনা দিয়ে,”যত মত তত পথ”-এর শাশ্বত বাণী। না কোনও ধর্মকে ছোট করা নয়,ধর্মের অন্ধ অভিমানে অহঙ্কার নয়,বরং সকল ধর্মের প্রতি সম্মান জানানো, শ্রদ্ধাশীল হওয়ার মতো এক অনন্যসাধারণ দর্শন। অন্যের প্রতি সহানুভূতিশীল হও,চেয়ে দেখো সেখানে ভগবান রয়েছেন জাগ্রত –এতো তাঁরই বাণী।
নিজেকে জানো,নিজেকে খোঁজো,কিন্তু জগৎকে উপেক্ষা করতে হবে না তার জন্যে। মানুষের জন্যে,মানুষের ব্যথায় শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব-এর মতো কাতর আর কেউ নন। স্নেহপরবশ তিনি একদিন দক্ষিণেশ্বরে মথুরবাবুর পুত্র ও তৎকালীন প্রধান ত্রৈলোক্যনাথ-কে এক প্রতিবেশীর অন্নকষ্ট প্রসঙ্গে বলেছিলেন–“নিজের মেয়ের বিয়েতে হাজার হাজার টাকা খরচ –আর পাশের বাড়িতে খেতে পাচ্ছে না।তাদের দুটি চাল দিতে কষ্ট– অনেক হিসেব করে দিতে হয়?…আমি আর আমার বাড়ির সকলে ভালো থাকলেই হোল।মুখে বলে সর্বজীবে দয়া।”
এই উদ্বেগে আছে সংহতি,সহমর্মিতা,সমানুভূতি দরদী মরমী এক মনের মানুষ। তাইতো অন্যান্য বেদান্তবাদী সাধুর মতো তিনি সাধারণ মানুষের জীবনের অস্তিত্ব অস্বীকার করেন নি।বরঞ্চ,প্রাধান্য দিয়ে স্বামী বিবেকানন্দকে বলেছিলেন “তুই বিরাট বট গাছের মতো হবি।কত মানুষ তোর আশ্রয়ে ঠাঁই পাবে,এসে শান্তিতে জিরোবে….,কক্ষনো শুধু নিজের কথা একদম ভাববি না।এমন কি নিজের মুক্তিও না।”
আহা কি অমৃত বানী।
তাইতো শ্রীরামকৃষ্ণ আপন করে নিয়েছেন বিহার থেকে আসা লাটু-কে,(স্বামী অদ্ভুতানন্দ),নটী বিনোদিনীকে,বৃন্দে ঝি-কে, চিনু শাঁখারি-কে, রসিকলাল মেথর-কে,।আপন করে নিয়েছেন তখনকার সমাজের বিদ্বজনেদের।আকর্ষণ করেছেন তাঁর সহজ সরলতা দিয়ে সারা জগতের জ্ঞানীগুণী থেকে আমাদের মতো সাধারণ অতি সাধারণ মানুষকেও।
ব্যক্তিসত্তার অস্তিত্ব যখন কেউ বৃহৎ পরিসরে অনুভব করে, এবং করতে পারে,তখনই তা হয়ে ওঠে–“আত্মনো মোক্ষার্থং জগদ্ধিতায় চ।”
আজ আমরা এক গভীর সঙ্কটে রয়েছি।রয়েছি এক দুরুহ অস্থিরতার মধ্যে।এই সময়ের ব্যক্তিক,সামাজিক সমস্যা যখন অসংখ্য অতৃপ্তি,জিজ্ঞাসা, আক্রোশ,অসহিষ্ণুতার নাগপাশে আমাদের শেষ করে ফেলছে।মানবিকতার অস্তিত্ব যখন বিপন্ন,অসহায়,হয়ে উঠছে,তখন আমাদের এই তমসায় আলোর পথ দেখাবেন আমাদেরই আপনজন,আমাদেরই কাছের জন,আমাদেরই আত্মার পরমাত্মীয় পরমাপ্রকৃতি পরমপুরুষ শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব। তাঁর পূণ্য আবির্ভাবের পবিত্রতায় রেখে গেলাম আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধা এবং প্রণাম।