প্রথম পাতা প্রবন্ধ ভারত পথিক তথা নবজাগরণের পথিকৃৎ… রাজা রামমোহন রায়

ভারত পথিক তথা নবজাগরণের পথিকৃৎ… রাজা রামমোহন রায়

189 views
A+A-
Reset

পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়

মেয়ে এসেছে বাপের বাড়িতে,সঙ্গে তার ৪বছরের ছেলে। মা-অন্ত প্রান সেই ছেলে। দাদামশাই শ্যামাচরন চট্টোপাধ্যায়(ভট্টাচার্য) সাত্ত্বিক তান্ত্রিক ব্রাহ্মণ..।একদিন পুজোর শেষে নাতিকে ঠাকুরের প্রসাদী বেলপাতা-তুলসীপাতা খেতে দিলেন।কাছেই ছিলেন মেয়ে মানে শিশুটির মা তারিনীদেবী..,তিনি নিষেধ করলেন শিশুটিকে সেই বেলপাতা -তুলসীপাতা খেতে। ছেলেটিও মায়ের কথা শুনে মুখথেকে থু থু করে সেসব ফেলে দিল। তাই দেখে রাগে অগ্নিশর্মা শ্যামাচরন অভিশাপ দিয়ে উঠলেন কন্যা তারিনীর দিকে তাকিয়ে..” এতো বড় সাহস,প্রসাদী বেলপাতা তুলসীপাতা কে অপমান…তোর এই ছেলে বড়ো হয়ে বিধর্মী হবে, দেখে নিস…”।

শোনা যায়,পরে দাদামশাই শ্যামাচরন চট্টোপাধ্যায় শান্ত হয়ে নাতিকে বুকে জড়িয়ে ধরে আশীর্বাদ করে বলেছিলেন, এই ছেলে জগৎসেরা হবে।মানুষকে নতুন আলোর পথ দেখাবে। সে এক অন্য কাহিনী।

তবে হ্যাঁ,পরবর্তী সময়ে তাই অক্ষরে-অক্ষরে সত্য হয়েছিল। সেই শিশুটি জন্মগ্রহণ করেছিলেন আজ থেকে ২৫০ বছর আগে,১৭৭২ সালের ২২শে মে এই বাংলার হুগলী জেলার রাধানগর গ্রামে এক নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ রামকান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় (রায়)এর দ্বিতীয় পুত্র হিসাবে। সেই ক্ষণজন্মা আলোকসুন্দর শিশুটিই হলেন রামমোহন.. সারাবিশ্বে যিনি রাজা রামমোহন রায় নামে বিখ্যাত।

জন্মের ২৫০ বছর পরেও রাজা রামমোহন রায় আমাদের ভারতবর্ষে আজও অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক।

রাজা রামমোহন ছিলেন প্রথম বাঙালী তথা ভারতীয় তথা এশিয়ান তথা এই পৃথিবীর অন্যতম একজন প্রাজ্ঞ ব্যক্তিত্ব, যিনি বাংলা, সংস্কৃত,হিব্রু,ইংরাজি, ল্যাটিন, গ্রীক,উর্দু, ফার্সী,আরবি,ফ্রেঞ্চ,রোমান,তিব্বতি,নেপালী,সহ বিশ্বের ৩২ টি ভাষা জানতেন।

তিনিই প্রথম এদেশে শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। তাই তিনি কলকাতায় হিন্দু কলেজ(এখনকার প্রেসিডেন্সী কলেজ ও ইউনিভার্সিটি) প্রতিষ্ঠার অন্যতম পথিকৃৎ ১৮১৭ সালে। তিনিই নিজের টাকায় প্রতিষ্ঠা করেন এংলো হিন্দু স্কুল (এখনকার হিন্দু স্কুল, কলেজ ষ্ট্রীট) ১৮২২ সালে।

গুণমুগ্ধ সাহেব ডেভিড হেয়ার -কে নিয়ে পরিকল্পনা করেছিলেন মেয়েদের শিক্ষার জন্য স্কুল খোলার,সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী পরে রামমোহনের স্নেহাস্পদ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মদনমোহন তর্কালঙ্কার,ড্রিঙ্কিংওয়াটার বীঠন(বেথুন সাহেব) এবং ডেভিড হেয়ার একত্রিত হয়ে বেথুন স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন।

রামমোহন রায়ের যখন ১৪ বছর বয়স,তখন তিনি ১৭৮৬ সালে গৃহত্যাগ করে সারা ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গা,এমন কি এদেশের বাইরে নেপাল, ভূটান,তিব্বত,শ্রীলঙ্কা, প্রভৃতি স্থান পরিভ্রমণ করেন,নিজের জন্মভূমিকে চিনতে শেখেন,জানতে চেয়েছিলেন স্বদেশের মানুষের জীবন-কথা।

১০ বছর পরিভ্রমণের পরে ১৭৯৬ সালে ফিরে আসেন। এই পরিভ্রমণ কালে তিনি দেখেছিলেন সারাদেশে নান্ধরনের সামাজিক অন্যায়।যেমন, মেয়েদের কিভাবে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারা হয় সতীদাহ নামক এক অসভ্য, বর্বর সামাজিক প্রথার নাম করে। যদিও এই ভারতবর্ষের কোনো শাস্ত্রে বা ইতিহাসের কোথাও এই অমানবিক, নৃশংস প্রথা বা নিয়মের কথা লেখা নেই। রামমোহন রায় এই প্রথাকে সমুলে বিনাশ করার মন্ত্র নেন মনে মনে সেইদিন, যেদিন তিনি শুনেছিলেন তাঁর বড়ো বৌদিকে পর্যন্ত জ্বলন্ত চিতার আগুনে সতীদাহের নামে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছিল।

অবশেষে অনেক লড়াইয়ের পর রাজা রামমোহন রায়ের একক প্রচেষ্টায় তৎকালীন বড়লাট লর্ড বেন্টিং ১৮২৯ সালের ৪ঠা ডিসেম্বর এদেশে সতীদাহ প্রথা নিষিদ্ধ করেন।

যদিও আজও এদেশে নারীদের কোনো সুরক্ষা নেই।আজও এদেশে পণপ্রথার জন্য বহু নারীকে পুড়িয়ে মেরে ফেলা হয়।আজও এদেশে কন্যাভ্রুন জন্মাবার আগেই হত্যা করা হয়। তাই আজও এদেশের সামাজিক ব্যবস্থায় রাজা রামমোহন রায় অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক, সেকথা অনস্বীকার্য।

শুধু,তাই নয়,রাজা রামমোহন রায় হিন্দুধর্মের,মুসলিম এবং খ্রিস্টান ধর্মের কোনো কূপমন্ডুকতাকে প্রশ্রয় দিতেন না,মানতেনও না। তাই তিনি হিন্দু,মুসলিম, খ্রিস্টান ধর্মের ভিতর থেকে জগতের এবং মানুষের জন্য কল্যানকর নির্যাসটুকু নিয়ে,১৮২৮ সালে ব্রাহ্ম ধর্ম এবং ব্রাহ্ম সমাজ প্রতিষ্ঠা করেন।এই ব্রাহ্ম ধর্ম এবং এই ব্রাহ্ম সমাজ আমাদের বাংলা তথা সারা ভারতবর্ষের বিভিন্ন ক্ষেত্রে,(সামাজিক,সাংস্কৃতিক,রাজনৈতিক,আর্থিক,ধর্মীয় দিক সহ..) আধুনিকতার,নবজাগরণের এক ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিত। যা আমাদের দেশের, জাতির,মননে,জীবনে এবং সবক্ষেত্রেই এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ,অনস্বীকার্য ইতিহাস।

আজও যখন এদেশে জাতপাত, জাত-ধর্ম বিভিন্নভাবে মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে,মানুষের মধ্যে উগ্র মৌলবাদীতার জন্ম দিচ্ছে,তখন অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক ভাবে সেই পরিস্থিতির মুখোমুখি এক বলিষ্ঠ প্রতিবাদ রূপে এসে উপস্থিত হন… রাজা রামমোহন রায়।

সেই সময়কার বাংলা তথা সারা ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গাতে রামমোহন রায়ের এই সর্বধর্ম সমন্বিত ব্রাহ্ম ধর্ম এবং ব্রাহ্ম সমাজের প্রভাব অত্যন্ত সক্রিয়ভাবে প্রভাবিত করেছিল,যা আজকের আমাদের এই আধুনিক সমাজের যতটুকু উন্নতি সম্ভব হয়েছে…এগুলি তারই ফলস্বরূপ ফলাফলের প্রতিফলন।

রাজা রামমোহন রায় বিশ্বাস করতেন,যে ঈশ্বর “একমেব অদ্বিতীয়ম্”…। এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সেই পরমব্রহ্মময়। তাই সকল প্রানীর মধ্যে বিরাজ করছেন সেই পরমেশ্বর। তিনিই বিভিন্ন রূপে বিভিন্ন ভাবে বিরাজ করছেন সর্বত্র। তাই কোনো বিদ্বেষ নয়,কোনো হানাহানি নয়,কোনো নীচতা নয়,…মানবিকতার আন্তরিক অনুভব দিয়ে পরস্পর পরস্পরকে আপন করে নেওয়াই হলো মানবের একমাত্র এবং আসল ধর্ম।

রাজ রামমোহন রায় সারাজীবন এদেশের সমাজ সংস্কারের জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করেছিলেন। সেই সময়ের সমাজ, পরিবার,আত্মীয়স্বজন,প্রতিবেশী, প্রায় সকলেই রামমোহনের এই সমাজ সংস্কারের কাজগুলির বিরুদ্ধতা করেছিলেন। তারা রামমোহনের সংস্রব ত্যাগ করেছিলেন,রামমোহনকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেছে,আক্রমণ করেছে,প্রানে মেরে দেবার ষড়যন্ত্র করেছে।তবু রামমোহন নিজের প্রতিজ্ঞায় ছিলেন অটল,অবিচল। পরিশেষে আমরা আজকের মানুষরা বুঝতে পারি,যে সেদিন রাজা রামমোহন রায় আমাদের দেশের মানুষের জন্য কি অপরিসীম লড়াই করেছিলেন, এই দেশের মাটি থেকে সমস্ত রকমের কলুষতা দূর করার জন্য।

অবশেষে ২৭ শে সেপ্টেম্বর, ১৮৩০ সালে ইংল্যান্ডের স্টেপলেটনের ব্রিস্টলের মাটিতে রাজা রামমোহন রায় অসীমের সেই অমর্তলোকে চির প্রস্থান করেন।

তাই আগামীকাল ২২ শে মে…২৫০ বছর পূর্ণ করে রাজা রামমোহন রায় পা দেবেন ২৫১ তম জন্মবার্ষিকীতে। আজ সেই মহাক্ষনের প্রাক্কালে আসুন আমরা সকলে মিলে রবীন্দ্রনাথের কথায় ” ভারত পথিক”..স্বামী বিবেকানন্দের কথায় “নবজাগরণের প্রথম মহাঋত্বিক…”, মহাত্মা গান্ধীর কথায়..” ভারতের ঈশ্বর”..,ঋষি অরবিন্দের কথায়…” শ্রেষ্ঠ মানবতার দূত.”.., নেতাজী সুভাসচন্দ্র বসুর কথায় “মুক্তি পথের পথিকৃৎ “…, খান আব্দুল গফ্ফর্ খান (সীমান্ত গান্ধী) -এর কথায়… “আলমগীর-ই-ইনসানিয়াৎ”…ভগিনী নিবেদিতার কথায় “আধুনিক ভারতের পথিকৃৎ “।

রাজা রামমোহন রায় -এর প্রতি রেখে যাই আমাদের বিনম্র প্রণাম।

আরও খবর

মন্তব্য করুন

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

সম্পাদকের পছন্দ

টাটকা খবর

©2023 newsonliy24. All Right Reserved.